বাঁ দিক থেকে ত্রিগুণাতীতানন্দ, শিবানন্দ, স্বামীজি, তুরীয়ানন্দ এবং ব্রহ্মানন্দ। নীচে বসে সদানন্দ (গুপ্ত মহারাজ)। ১৮৯৯ সালে বাগবাজার বোসপাড়া লেনে। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
আরও পড়ুন: হাতে মাইক, মনে জেদ, হাথরসের দুই আসল বীরাঙ্গনা
কয়েক দিন হাথরসে কাটানোর পর ফের পথে পথে বেরিয়ে পড়তে তৈরি হলেন স্বামীজি। ভেঙে পড়েছিলেন শরৎ। প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা অনুভব করেছিলেন। হঠাৎই, ‘‘আমাকে আপনার শিষ্য করিয়া লউন’’— স্বামীজির কাছে আবেদন করে বসলেন শরৎ গুপ্ত। শুনে বিবেকানন্দ তো পড়লেন বিপাকে। শরৎকে নিরস্ত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই বেপরোয়া এবং দুঃসাহসী শরৎ। সহজে ছাড়ার পাত্র ছিলেন না। বিবেকানন্দকেও তিনি রেহাই দিলেন না।
প্রমথনাথ লিখেছেন, শেষে স্বামীজি নাছোড়বান্দা শরৎকে নিজের ভিক্ষাপাত্র দিয়ে স্টেশনের কুলিদের থেকে ভিক্ষা করে আনতে বলেন। তাতেই রাজি হন শরৎ। চমকে যান স্বয়ং বিবেকানন্দও। এর কিছু দিন পরেই স্টেশনের কাজের দায়িত্ব এক জনের ঘাড়ে চাপিয়ে স্বামীজির সঙ্গে ঋষিকেশ যাত্রা করেন শরৎ গুপ্ত, গৃহী জীবনের নাম ত্যাগ করে তার পর যিনি হয়ে উঠবেন স্বামী সদানন্দ ওরফে গুপ্ত মহারাজ।
সদানন্দের জন্ম কলকাতার গড়পারে। তবে বাংলার জলহাওয়ায় বেড়ে ওঠা হয়নি তাঁর। তিন বছর বয়সে তাঁর পরিবার কাশীর কাছে জৌনপুরে চলে যায়। বাংলার থেকে হিন্দিটাই বেশি ভাল জানতেন। প্রথম বার স্বামীজির সঙ্গে ঋষিকেশ ভ্রমণে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন সদানন্দ। তাঁকে ফের হাথরসে ফিরিয়ে আনেন বিবেকানন্দ। সেখানে তাঁকে রেখে কিছু দিন পর কলকাতায় মঠে ফেরেন তিনি। পাহাড় ভ্রমণে সদানন্দ বুঝতে পারেন সন্ন্যাসীদের জীবন কতটা কঠোর। কিন্তু সংসার জীবনে অভ্যস্ত সদানন্দ পিছিয়ে আসেননি। বরং সুস্থ হতেই তিনি হাথরস থেকে চলে যান কলকাতায়, বিবেকানন্দের কাছে, মঠে।
এ তো গেল উদ্যোগ পর্ব। কুরুক্ষেত্র পর্ব এসে উপস্থিত হল কলকাতায় প্লেগের সময়। সদানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ আর এই প্লেগপর্বের মধ্যেই স্বামীজি জয় করে এসেছেন শিকাগোর ধর্মমহাসভা। দেশ ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছেন মার্গারেট, পরে যিনি ভগিনী নিবেদিতা। এ সব চলতে চলতেই ১৮৯৬ সালে দেশের বিভিন্ন অংশে দেখা দিয়েছিল প্লেগের আক্রমণ। ১৮৯৮ সালে কলকাতাতেও থাবা বসাল প্লেগ। সেটা প্রথম ধাক্কা। দ্বিতীয় ধাক্কাটা এল ঠিক তার পরের বছর, আরও বড় আকারে, ভয়াবহ ভাবে। মহানগরীতে প্লেগের সেই দিনগুলির কথা নিজের লেখায় তুলে ধরেছেন সাহিত্যিক শংকর। লিখেছেন, ‘‘রামকৃষ্ণ মিশনের ইতিহাসে বলা হচ্ছে, মহুলায় দুর্ভিক্ষ ত্রাণ কার্যের শুরু ১৫ মে ১৮৯৭, তার পর দেওঘর এবং দিনাজপুর। এর পর মহুলার অনাথ আশ্রম। এর পরেই কলকাতার প্লেগসেবা, ১৮৯৮ থেকে ১৯০০। তার পর ভাগলপুর। প্লেগের জন্য যে কমিটি নিযুক্ত হল, তার অফিসার ইন চিফ স্বামী সদানন্দ, প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি বিদেশ থেকে নবাগতা সিস্টার নিবেদিতা। এঁদের সহায়ক স্বামী শিবানন্দ, স্বামী আত্মানন্দ এবং স্বামী নিত্যানন্দ।’’
কলকাতার প্লেগ, স্বামীজি, সদানন্দকে নিয়ে শংকরের এই লেখাটা করোনা পর্বের গোড়ায় আনন্দবাজার ডিজিটালেই প্রকাশিত হয়েছিল। এ বার হাথরস প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি বললেন, “হাথরস বিখ্যাত ছিল এতদিন স্বামীজি-সদানন্দ সাক্ষাতের জন্য। শুনেছিলাম ওই স্টেশনে একটা ফলকও লাগানো হয়েছিল সেই ঘটনা স্মরণ করে। কিন্তু এ বার যে ঘটনা হাথরসকে প্রচারে আনল তা সত্যিই লজ্জার।” কথা বলতে বলতেই এক সময় প্রবীণ সাহিত্যিকের গলায় ঝড়ে পড়ল আক্ষেপ— “স্বামীজির প্রথম সন্ন্যাসী শিষ্যই শুধু তিনি নন, সদানন্দ এক দুর্লভ চরিত্র। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ সন্ন্যাসীকে নিয়ে আজও একটাও ভাল বই লেখা হল না। ভীষণ দরকার এটার, ভীষণ দরকার।” শংকরের মতে, “যোগ্য সমাদর, যোগ্য স্বীকৃতি হয়নি ওঁর। কাব্যে উপেক্ষিতা বলা যায়।” আপনি কি ওঁকে নিয়ে লেখার কথা ভাবছেন? ফের আক্ষেপেরই সুর— “এই বয়সে ঘরবন্দি হয়ে যে অবস্থায় রয়েছি, লাইব্রেরিতেও তো যেতে পারব না। এটা বড় কাজ। অনেক খোঁজাখুঁজি করতে হবে।”
প্লেগের সময় বাংলা ও হিন্দিতে মঠের পক্ষ থেকে একটা প্রচারপত্রও বিলি করা হয় কলকাতার পাড়ায় পাড়ায়। সেটা প্রথম ইংরেজিতে লেখেন নিবেদিতা। গোটা ব্যবস্থাপনায় অগ্রণী ভূমিকা ছিল সদানন্দের।