Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Terrorism

বার বার নাম বদলাচ্ছে জঙ্গি সংগঠন, চোখে ঠুলি পরে নিজেই বিপন্ন পাকিস্তান

হাফিজ সইদের লস্কর-ই-তৈবা এবং মাসুদ আজহারের জইশ-ই-মহম্মদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তালিবানরা তো আরও অনেক আগেই নিষিদ্ধ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৯ ২১:৪৫
Share: Save:

বছর দশেক আগের কথা। অত্যন্ত প্রভাবশালী এক মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক আমেরিকার সরকারের রিপোর্ট পেশ করল এবং পাকিস্তানের ‘ফাটা’ অঞ্চলকে ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান’ হিসেবে চিহ্নিত করার কথা সুপারিশ করল। শুধু আফগানিস্তানকে নয়, পাকিস্তানের ‘ফাটা’ অঞ্চলকেও ‘ওয়ার জোন’ হিসেবে ঘোষণা করার পরামর্শ দিয়েছিল মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্কটি। হোয়াইটহাউস শেষ পর্যন্ত তা করেনি। কিন্তু ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট ওবামার মুখে শোনা গিয়েছিল কথাটা— ফাটা অঞ্চল হল পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান।

অর্থাৎ এক দশক আগে থেকে পাক সরকার ইঙ্গিত পাচ্ছিল, অন্তর্জাতিক মহলের সামনে কী রকম ভাবমূর্তি তৈরি হচ্ছে দেশটার। কিন্তু জঙ্গি সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে লোকদেখানো পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই করেননি ইসলামাবাদ এবং রাওয়ালপিন্ডির কর্তারা। ফলাফল সকলের চোখের সামনে। গোটা পৃথিবী এখন সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে বড় কারখানা হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলেছে পাকিস্তানকে। কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চল আর নয়, প্রায় গোটা পাকিস্তানটাই এখন যেন চিহ্নিত ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে।

পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান সীমান্তে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ‘ফাটা’। পুরো নাম— ফেডেরালি অ্যাডমিনিস্টার্ড ট্রাইবাল এরিয়া (এফএটিএ)। আফগান তালিবান, তেহরিক-এ-তালিবান (যাদের কার্যকলাপ মূলত পাকিস্তানে), আইএস-সহ নানা জঙ্গিগোষ্ঠীর মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠেছিল এই উপজাতি প্রধান অঞ্চল অনেক দিন আগেই। সেই কারণেই ফাটা-কে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলা হয়েছিল এক দশক আগেই।

আরও পড়ুন: পাক জঙ্গি ঘাঁটিতে অভিযান চলবে! ইঙ্গিত বায়ুসেনা প্রধানের বক্তব্যেও​

পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলা হওয়ার পরে পাকিস্তানে চলতে থাকা জঙ্গি পরিকাঠামো নিয়ে যে সব চর্চা সামনে আসছে, তাতে গোটা বিশ্ব জেনে গিয়েছে, পঞ্জাব হোক বা খাইবার পাখতুনখোয়া, ফাটা হোক বা বালুচিস্তান— পাকিস্তানের কোনও অঞ্চলই সন্ত্রাসের ছায়া থেকে আর মুক্ত নয়।

হাফিজ সইদের লস্কর-ই-তৈবা এবং মাসুদ আজহারের জইশ-ই-মহম্মদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তালিবানরা তো আরও অনেক আগেই নিষিদ্ধ। তা হলে কী ভাবে দিনের পর দিন পাকিস্তানের মাটিতে অবাধে কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে এই সব সংগঠন? আসলে নিরন্তর আন্তর্জাতিক মহলের চোখে ধুলো দেওয়ার একটা খেলা চলছে।

যে সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে, সেটি তৎক্ষণাৎ নাম বদলে ফেলছে। তার পরে নতুন নাম নিয়ে অবাধে জঙ্গি কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানের প্রত্যেকটি প্রতিবেশী দেশে জঙ্গি হামলা হচ্ছে। কোনও কোনও সংগঠন পাকিস্তানেও নাশকতা ঘটাচ্ছে।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

হাফিজ সইদ: ১৯৮৭ সালে লস্কর-ই-তৈবা তৈরি করেছিলেন হাফিজ সইদ। ভারতের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় থাকা এবং আন্তর্জাতিক ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়া হাফিজের সংগঠনকে পাকিস্তান নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। কিন্তু হাফিজ সইদ পত্রপাঠ বদলে দেন সংগঠনের নাম— জামাত-উদ-দাওয়া নামে কাজ শুরু করে তাঁর লোকজন। ২০০৮ সালে সাময়িক ভাবে নিষিদ্ধ হয়েছিল জামাত-উদ-দাওয়া। আবার নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নামতে পারে জেনে ফালাহ-ই-ইসানিয়ত নামে আর এক ব্যানার বানিয়ে ফেলেন হাফিজ। সেই ব্যানারে চলতে থাকে সন্ত্রাসের বীজ বপনের কাজ। ২০১৮ সালে জামাত-উদ-দাওয়া এবং ফালাহ-ই-ইনসানিয়ত ফাউন্ডেশনকেও পাকিস্তান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সঙ্গে সঙ্গে দু’টি নতুন নাম বাজারে এনেছেন হাফিজরা— আল মদিনা এবং আইসর ফাউন্ডেশন।

জইশ-ই-মহম্মদ: পুলওয়ামা হোক বা পঠানকোট— সাম্প্রতিক কালে ভারতে অধিকাংশ বড় জঙ্গিহানার নেপথ্যে জইশ। মৌলানা মাসুদ আজহারের এই সংগঠন পাকিস্তানের মাটিতে অবাধে জঙ্গি প্রশিক্ষণ চালাচ্ছে। পাক সেনা এবং আইএসআই-এর প্রত্যক্ষ সহায়তায় ভারতে নাশকতা চালাচ্ছে। ১৯৯৯ সালে ভারতীয় বিমান ছিনতাই করে তালিবান শাসিত আফগানিস্তানের কন্দহরে নিয়ে গিয়ে যাত্রীদের পণবন্দি করে জঙ্গিরা। ভারতের জেল থেকে মাসুদ আজহারের মুক্তির বিনিময়ে ওই বিমান এবং পণবন্দিদের ছাড়া হয়। তার পরে ২০০১ সালে সংসদে জঙ্গিহানার সঙ্গে নাম জড়িয়েছিল জইশের।

আরও পড়ুন: জেতা আসন ছাড়তে নারাজ সিপিএম, রাহুল-অধীর বৈঠক

ভারত বেশ কয়েক বছর ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে জইশ এবং মাসুদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিষেধাজ্ঞা আদায় করতে। বার বার সে প্রস্তাব রাষ্ট্রপুঞ্জে জমা পড়ছে। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্যের মধ্যে চারটি দেশই এই নিষেধাজ্ঞায় রাজি। কিন্তু পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতম মিত্র চিনের বাধায় বার বার আটকে যাচ্ছে মাসুদকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার চেষ্টা।

পুলওয়ামা জঙ্গিহানার পরে ফ্রান্স ফের মাসুদ এবং জইশের বিরুদ্ধে প্রস্তাব এনেছে। তার উপরে ভোটাভুটি হওয়া এখনও বাকি।

তেহরিক-ই-তালিবান এবং লস্কর-এ-জঙ্গভি: এই দুই সংগঠনই আইএস-এর সঙ্গে যোগ রেখে সন্ত্রাসবাদী কাজ চালাচ্ছে। ভারত নয়, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানেই নাশকতা চালায় এই সংগঠনগুলি। ২০১০ সালে আমেরিকা এই দুই সংগঠনকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। লস্কর-ই-জঙ্গভি-কে পাকিস্তান নিজে নিষিদ্ধ করেছিল ২০০৩ সালে আর তেহরিক-ই-তালিবানকে ২০১১ সালে। কিন্তু আইএস-এর সঙ্গে জুড়ে গিয়ে নিজেদের পরিচয় লুকনোর নানা বন্দোবস্ত করে ফেলেছে এরা। নিজের দেশে ঘটতে থাকা নাশকতাও রুখতে পারছে না পাকিস্তান। ২০১৪ সালে পেশওয়ারে সেনাবাহিনীর স্কুলে তেহরিক-ই-তালিবানের ভয়াবহ হামলায় ১৩২ জন শিশুর মৃত্যুর ক্ষত ভুলতে পারা পাকিস্তানের পক্ষেও কঠিন। তা সত্ত্বেও নিজেদের দেশ থেকে যাবতীয় জঙ্গি মুক্তাঞ্চল নির্মূল করার শপথ নিতে দেখা যায় না ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডির কর্তাদের।

(আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক চুক্তি, আন্তর্জাতিক বিরোধ, আন্তর্জাতিক সংঘর্ষ- সব গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক খবর জানতে চোখ রাখুন আমাদের আন্তর্জাতিক বিভাগে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE