তিনি অভিনেত্রী। কি মঞ্চ, কি টিভির পর্দা, কি রুপোলি পর্দা— সর্বত্রই তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। সাজগোজ দেখলে বোঝা যায় তিনি জানেন কোথায় থামতে হয়। এক সহকর্মী জানালেন, অভিনেত্রী চৈতি ঘোষালের বাড়িতেও তাঁর শিল্পবোধের পরিচয় মেলে। নিজের চারপাশটাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতে ভালবাসেন চৈতি। পুজোর তারকাদের অন্দরসজ্জার গল্প শুনতে তাই আনন্দবাজার ডট কম হাজির হল তাঁর কাছে।
প্রশ্ন: শুনেছি আপনার বাড়ি বেশ সাজানোগোছানো, পুজোর সময়ে কি আলাদা করে ঘর সাজান?
চৈতি: পুজোর আগে ঘর সাজানোর তোড়জোড় করতে মাকে দেখতাম। কারণ, আমার বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়।
প্রশ্ন: তাই নাকি?
চৈতি: হ্যাঁ। দুর্গাপুজোটা হঠাৎই শুরু হয়েছিল। আমার বাবা অভিনেতা শ্যামল ঘোষাল ‘যুক্তি তর্ক গপ্পো’র শুটিং করতে শান্তিনিকেতনে গিয়ে একটি কাঠের দুর্গাপ্রতিমা কিনে আনেন। সেই দুর্গামূর্তি তৈরি করেছিলেন শিল্পী রামকিঙ্কর বেজ। বুঝতেই পারছেন, অসাধারণ একটা আর্ট ফর্ম ছিল সেটা। তখনকার দিনে হাজার টাকা বায়না করে ওটা কিনেছিলেন বাবা। তার পর থেকেই বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু হয়। আমার মা পুজোর সময়ে চণ্ডীপাঠ করতেন। বাড়িতে ফিল্মের জগতের লোকজন আসতেন। আমি বড় হয়ে অভিনয়ে আসার পরে আমার অভিনয় জগতের বন্ধুরাও আসতেন। তাই গোটা বাড়িটাই ঝারপোঁছ করে সাজানো হত। মা পুরোটা দেখতেন। মায়ের সঙ্গে আমিও হাত লাগাতাম। সেই মূর্তি এখনও রয়েছে বাড়িতে। এখনও পুজো হয়। আর পুজোর আগে ঘরদোর সাজানোর অভ্যাসটাও যায়নি।
রামকিঙ্কর বেজের হাতে তৈরি দুর্গাপ্রতিমার পুজো হত বাড়িতে। তার আগে মা গোটা বাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সাজিয়ে তুলতেন।
প্রশ্ন: পুজোর সময় কী ভাবে ঘর সাজান?
চৈতি: আমার বাড়িতে প্রচুর পেন্টিং আছে। ক্যামেরায় তোলা ভাল ভাল ছবিও আছে। আর আছে বাইরে বেড়াতে গিয়ে কেনা কিছু স্মারক। যা সেই সব জায়গার স্পেশ্যালিটি। আবার অনেক বন্ধুও বিদেশ থেকে নানা রকম উপহার পাঠিয়েছেন। সেই সব জিনিসপত্র দিয়েই বছরের একটা সময় ঘর সাজানো হয়। অধিকাংশ সময় সেটা পুজোর আগেই হয়। এ বার যেমন ঠিক করেছি দুটো বড় ছবি টাঙাবে দেওয়ালে। ওগুলোকে বলা হয় সায়নোটাইপ।
পুরনো জিনিস দিয়ে সাজানো চৈতির বাড়ি। তার মধ্যে একটি বহু পুরনো গ্র্যান্ডফাদার ক্লক।
প্রশ্ন: সায়নোটাইপ ব্যাপারটা কী?
চৈতি: ক্যামেরায় তোলা ছবি থেকে শুধু নীল রং টাকে বইয়ে দেওয়া হয়। ফলে গোটা ছবিটায় নীলচে রঙের প্রভাবে একটা অদ্ভুত মায়াবী আবহ তৈরি হয়, যেটা দেখতে দারুণ আর্টিস্টিক লাগে। এ ছাড়া অমর্ত্যের ফিল্মের ক্যামোরায় তোলা ছবি আছে, ওর বাবার তোলা কিছু ছবিও আছে। আসলে ছবি দিয়ে ঘর সাজাতে ভাল লাগে আমার।
সায়নোটাইপ ছবি চৈতির এ বারের পুজোর অন্দরসজ্জার মূল আকর্ষণ।
প্রশ্ন: কখনও সাধ্যের বাইরে গিয়ে দামি ছবি বা ঘর সাজানোর জিনিস কিনেছেন?
চৈতি: আমার বাড়িতে সকলেরই ছবির ব্যাপারে একটা ঝোঁক
আছে। মা তো পেন্টিংয়ের জন্য বাড়িও বিক্রি করে দিতে পারতেন। তবে আমি একটু
বুঝে খরচ করি। ভাবনাচিন্তা করে কিনি। পেন্টিং কিনতে বহু বার সিমা গ্যালারিতে
গিয়েছি। কিন্তু ওখানে এত ভাল ভাল কাজ থাকে যে, কোনটা ছেড়ে কোনটা কিনব বুঝতেই
পারি না। তবে আমার কাছে থাকা সবচেয়ে ‘দামি’ ছবি হল একটা হাতে আঁকা আমার পোট্রেট। এক শিল্পী
রবীন্দ্রনাথের নাটকের নারী চরিত্রের সিরিজ় আঁকছিলেন। আমার ছবিটি উনি এঁকেছিলেন রক্তকরবী নাটকে আমার অভিনয় দেখার পরে। অভিনেত্রী হিসাবে ওই ছবিটা আমার কাছে একটা বড়
পাওয়া। ওটা তাই আমার বাড়ির চোখে পড়ার মতো একটা জায়গায় টাঙিয়ে রাখি।
চৈতির কাছে সবচেয়ে মূল্যবান ঘর সাজানোর জিনিস তাঁর নিজেরই একটি পোট্রেট।
প্রশ্ন: ছবি, পেন্টিং পুরনো দুর্গামূর্তি, আপনার বাড়ি তো দেখছি গল্প দিয়ে সাজানো..
চৈতি: একেবারেই। আমি বাড়িতে অধিকাংশ সময়েই একা থাকি। আমার ছেলে পুজোর সময় এসেছে বটে। তবে ও ফিল্ম ইনস্টিটিউটে পড়ে। মুম্বইয়ে থাকে। বাড়িতে যখন একা থাকি, তখন বাড়ির প্রত্যেকটা জিনিসের সঙ্গে জুড়ে থাকা গল্পেরাই আমরা সঙ্গী হয়। অনেক পুরনো জিনিসও রয়েছে আমার বাড়িতে একটা পুরনো গ্র্যান্ডফাদার ক্লক। পুরনো কাঠের চেয়ার। পুরনো অদ্ভুত আদলের একখানা আলনা। এগুলো হঠাৎ হঠাৎ যখন চোখে পড়ে, তখন সেই সব পুরনো গল্পে হারিয়ে যাই। মন ভাল হয়ে যায় তখন।
ছেলের ঘরের দেওয়াল ভর্তি আঁকিবুকি। সেই ঘরই চৈতির শান্তির আশ্রয়।
প্রশ্ন: প্রত্যেকটা বাড়িতেই এমন একটা জায়গা থাকে, যেখানে গেলে মনে শান্তি আসে। কোনও সমস্যা এলে বা কঠিন পরিস্থিতিতে সেই জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিতে ইচ্ছে করে। আপনার বাড়িতেও কি তেমন জায়গা আছে?
চৈতি: আছে। আমার ছেলের ঘরটা। ওর ঘরটা অদ্ভুত। ওর ঘরের দেওয়ালে গ্রাফিটি করা আছে। যাকে বলে দেওয়াল লিখন। বহু মানুষ ওই দেওয়ালে অনেক কিছু লিখে গিয়েছেন। ওর বাবা, বন্ধুরা, শিক্ষক, পরিচিতজনেরা এমনকি, ও নিজেও অনেক সময় অনেক কিছু লিখেছে, এঁকেছে। সেই লেখাগুলো ঘরের অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। মাঝেমাঝে যখন মনঃসংযোগ করার দরকার হয় তখন আমি ওর ঘরটায় গিয়ে বসি। ওই লেখাগুলো দেখি। হয়তো হঠাৎ ওর হাতে লেখা একটা লাইন খুঁজে পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু মনে পড়ে যায়। ওর ছোটবেলার কথা। আরও অনেক কিছু। আসলে ছেলে যে আমায় ছেড়ে থাকছে, এটা এখনও আত্মস্থ করে উঠতে পারিনি আমি। তাই মাঝেমাঝেই ওই ঘরে গিয়ে সময় কাটাই। ওটাই বাড়িতে আমার শান্তির ঠিকানা।