শরীরের স্বাভাবিক রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা থেকেই জন্ম ইনফ্ল্যামেশন বা প্রদাহের। বাইরে থেকে কোনও প্রকারের ব্যাকটিরিয়া, ভাইরাস বা যে কোনও ধরনের আক্রমণ শরীরের উপরে এলে শরীরের স্বাভাবিক ইমিউন সিস্টেম জানান দেয় ইনফ্ল্যামেটরি কোষগুলিকে। শ্বেত রক্তকণিকার মাধ্যমে বিভিন্ন রাসায়নিক, উৎসেচকের প্রতিরোধ তৈরি হয় ও বিভিন্ন লক্ষণের মাধ্যমে শরীর তা জানান দেয়। এই লক্ষণগুলি হল, কোনও জায়গা ফুলে যাওয়া, লাল হয়ে যাওয়া, ব্যথা, গরম হয়ে যাওয়া বা অন্য কোনও অস্বাভাবিকতা। এই পুরো প্রক্রিয়াটিই ইনফ্ল্যামেশন বা প্রদাহের আকারে ধরা দেয় আমাদের কাছে। ইনফ্ল্যামেশনের যন্ত্রণা অনেক সময়ে আমরা সহ্য করতে পারি না, তবে প্রাথমিক ভাবে শরীরের ভালর জন্যই তৈরি হয় ইনফ্ল্যামেটরি রেসপন্স।
প্রদাহ নানা ধরনের
ইনফ্ল্যামেশন কখনও স্থানীয় বা তাৎক্ষণিক কারণে তৈরি হয়, যেমন, কোথাও কেটে বা ছড়ে যাওয়া, আঘাত পাওয়া ইত্যাদি। আবার ক্রনিক বা দীর্ঘকালীন ইনফ্ল্যামেশনও হতে পারে। আর্থ্রাইটিসের ব্যথা, ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোমের মতো দীর্ঘকালীন ইনফ্ল্যামেটরি রেসপন্সও তৈরি হতে পারে শরীরে। দু’ক্ষেত্রের চিকিৎসা আলাদা। ক্রনিক ইনফ্ল্যামেশনের ক্ষেত্রে সারাজীবন ওষুধ বা স্টেরয়েডের সাহায্য নিতে হতে পারে রোগীকে। সেখানে অ্যাকিউট ইনফ্ল্যামেশনের চিকিৎসা চিরস্থায়ী নয়। সাধারণ অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগসের মাধ্যমেই এর নিরাময় সম্ভব।
আবার ব্যক্তিবিশেষে ইনফ্ল্যামেটরি রেসপন্সের প্রকারভেদও আলাদা রকমের হয়। চিকিৎসকেরা এ কারণ অনুসন্ধান করে তবেই চিকিৎসা শুরু করে থাকেন। যেমন, ওবেসিটি থাকলে সেই সব রোগীর ইনফ্ল্যামেটরি রেসপন্স খুব দ্রুত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে প্রসঙ্গ চলে আসে জীবনযাত্রা ও খাওয়াদাওয়ার অভ্যেসের। মেনোপজ় হয়ে গিয়েছে এমন এক মহিলা পা ফোলা বা ব্যথায় যত দ্রুত আক্রান্ত হবেন, একজন বছর কুড়ির তরুণী তা হবেন না। কারণ, মেনোপজ়ের পরে সেই মধ্যবয়স্কার শরীরে ফিমেল হরমোনের স্বাভাবিক মাত্রা কমে যাওয়ায় ইনফ্ল্যামেটরি রেসপন্সের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
জেনারেল মেডিসিনের চিকিৎসক সুবীর কুমার মণ্ডলের কথায়, ‘‘চিরস্থায়ী ভাবে ইনফ্ল্যামেটরি রেসপন্স বন্ধ করে দেওয়ার ওষুধ দেওয়া উচিত নয়, দেওয়া হয়ও না। লোকাল বা সিস্টেমেটিক ভাবে এর চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। ইনফ্ল্যামেশন আমাদের সহনশীলতার মধ্যে থাকুক বা না থাকুক, বাহ্যিক আঘাত না লাগলে এটি কিন্তু শরীরে এক ধরনের অটো-ইমিউন রেসপন্স তৈরি করে, যা শরীরের জন্য দরকারি।’’
কেন হয় এই প্রদাহ?
কোনও অর্গ্যানের বিরুদ্ধে যখন শরীর অ্যান্টিবডি তৈরি করে, রাসায়নিক নিঃসরণের মাধ্যমে সেই অর্গ্যানের বিরুদ্ধে রিঅ্যাক্টিভ প্রোটিন তৈরি হয়। ধীরে ধীরে সেই অঙ্গের কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করে। শরীরের অটো-ইমিউন রেসপন্সের মাধ্যমেই এমনটা হয়ে থাকে। ইনফ্ল্যামেশনের প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় রাসায়নিক চেন। ক্যাপিলারি পারমিয়েবিলিটি বেড়ে যায়। প্লাজ়মা, প্রোটিন বেরিয়ে আসে ও ফ্লুয়িড জমে জায়গাটি ফুলে যায়, ব্যথা করে। শ্বেত রক্তকণিকা তখন আইএলসিক্স (ইন্টারলিউকেন সিক্স) কেমিক্যাল তৈরি করে এবং ইনফ্ল্যামেটরি চেনটিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগের প্রয়োগে এই চেনটিই ভাঙার চেষ্টা করা হয়।
চিকিৎসার নানা রূপ
সাধারণত ইনফ্ল্যামেশনের প্রাথমিক চিকিৎসায় নন স্টেরয়েডাল অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগ (এনএসএআইডি)-এর ব্যবহার দেখা যায়। এটির প্রয়োগে সেই অর্গ্যানের ইনফ্ল্যামেটরি রেসপন্স বন্ধ হয়ে যায়। প্যারাসেটামল যেমন খুব চেনা একটি অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগ। আবার ক্ষেত্রবিশেষে নানা সাপ্লিমেন্ট দিয়েও ইনফ্ল্যামেশনের চিকিৎসা চলে। তবে সেগুলি মূলত প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসা।
কোনও ক্রনিক ডিজ়িজ়ের ক্ষেত্রে অনেক সময়েই স্টেরয়েডের সাহায্য নেওয়া হয়ে থাকে। তবে স্টেরয়েডের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও আছে। হয়তো দেখা গেল, স্টেরয়েডের সাহায্য নিয়ে ইনফ্ল্যামেশন বা প্রদাহ বন্ধ হলেও রোগীর সুগার বেড়ে যাচ্ছে। তাই স্টেরয়েডের প্রয়োগ দরকার হলে, সব দিক বিচার করে তবেই নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা।
মনে রাখতে হবে, প্রতিটি অর্গ্যানের ক্ষেত্রে ইনফ্ল্যামেটরি রেসপন্স আলাদা। টাইপ ওয়ান ডায়াবিটিসও এক ধরনের অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি রেসপন্স। এ ক্ষেত্রে প্যানক্রিয়াসের বিটা সেলের বিরুদ্ধে শরীর অ্যান্টিবডি তৈরি করতে শুরু করে ও সেলগুলি ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে ইনসুলিন তৈরি হওয়ায় বাধা পড়ে। ডায়াবিটিসের সূত্রপাত সেখান থেকেই। আবার আর্থ্রাইটিসের ক্ষেত্রে কার্টিলেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেখানে কতকগুলি ইনফ্ল্যামেটরি কেমিক্যাল তৈরি হয়। শরীরে এই রাসায়নিকের মাত্রা অত্যধিক বেড়ে গেলে একটা সময়ের পরে আর নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় না। তখন স্টেরয়েডের সাহায্য নিতে হয়।
বাহ্যিক চোট-আঘাত ও প্রদাহ
এই ধরনের চোট বা আঘাত থেকে হওয়া সাময়িক প্রদাহের চিকিৎসা প্রাথমিক ভাবে কোল্ড কমপ্রেস, প্যারাসেটামলের মতো অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগের মাধ্যমেই করা হয়ে থাকে। তবে এই ধরনের চিকিৎসা একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ের। কোল্ড কমপ্রেস বা ঠান্ডা সেঁকের ফলে ব্লাড ভেসেলগুলি সঙ্কুচিত হয়ে যায়। ফলে বেশি ফ্লুয়িড সার্কুলেশন হতে পারে না এবং ব্যথা ও ফোলা ভাব কমতে থাকে।
ইনফ্ল্যামেশনের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে সচেতন থাকলে ও ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করলে সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা যায় যে কোনও অসুখ। তাই কোনও ধরনের প্রদাহই অবহেলা করবেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy