চাঁদ সওদাগরের ছেলের বিয়ে। পুত্রবধূ বেহুলা এসেছেন শ্বশুরালয়ে। অতিথি সমাবেশে গমগম চাঁদের বাড়ি। বিয়ের ভোজের এলাহি আয়োজন। রান্না হচ্ছে নিরামিষ, আমিষ ও হরেক রকমের মিষ্টি। বেসন দিয়ে চিতল মাছের কোল ভাজা, বড় বড় কই মাছ ভাজা জিরে লবঙ্গ মাখিয়ে, লঙ্কা দিয়ে মাগুর মাছের ঝোল, আম দিয়ে কাতলা মাছ, মহাশোলের অম্বল, চিংড়ি মাছের রসলাস, রুই মাছের মাথা দিয়ে মাষকলাইয়ের ডাল, পাবদা মাছ ও আদা দিয়ে শুকতুনি, শোল পোনা ভাজা, তেঁতুল লঙ্কা-সহ বোয়াল মাছের ঝাঁটি, পুঁটি মাছ ভাজা— প্রায় আঠারো ধরনের মাছের পদ।
এখানেই ইতি নয়। মাংস না খাওয়ালে গৃহকর্তার মান থাকে না। তার উপর তিনি যখন চাঁদ সওদাগর। সে দিন ছিল হরিণ, পাঁঠা, ভেড়া, পায়রা ও কচ্ছপের মাংসের ঝাল-ঝোল-অম্বল। নারকোল ভাজা দিয়ে খাসির চর্বি আজ কল্পনাতীত। কচি পাঁঠা বা খাসির জমানার আগে মাছে-ভাতে বাঙালির প্রিয় ছিল হরিণের মাংস। তবে শজারু, শুয়োর, গোসাপ, হাঁস, মুরগি কিছুই বাদ দিত না। ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে কবি বিজয় গুপ্ত লিখেছেন, এমন অনেক ব্যঞ্জনের কথা, যা আজ লুপ্ত তো বটেই, সে সবের নাম শুনলে অনেকেই চমকাবেন। মাছে ভাতে বাঙালি যে যথেষ্ট মাংসাশী ছিল তার আরও প্রমাণ মেলে ষোড়শ শতকে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ। সেখানে তো মাংসের ছড়াছড়ি। নিদয়ার শখ, সাধভক্ষণে তিনি খাবেন নকুল গোধিকা আর শজারু পোড়া! ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’-এ ভবানন্দ মজুমদারের স্ত্রী পদ্মমুখী ব্রাহ্মণ ভোজনের জন্য তরিবত করে রাঁধছেন— আম দিয়ে শোল মাছ, বাচা মাছের ঝোল, ভেটকি, কই, খয়রা মাছ ভাজা। তেতো রাঁধছেন পচা মাছ দিয়ে, তিতকুটে স্বাদ কাটানোর জন্য দিচ্ছেন গুড়। মাছের এত পদের সঙ্গে ছিল কাছিমের ডিম সেদ্ধ ও ডিমের বড়া।
উনিশ শতকে প্রকাশিত হয় বাঙালির প্রথম রান্নার বই। ১৮৩১ সালে, বিশ্বেশ্বর তর্কালঙ্কার ভট্টাচার্যের ‘পাক রাজেশ্বর’। এর পর ১৮৫৮ সালে গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশের ‘ব্যঞ্জন রত্নাকর’। বিশ্বেশ্বর তর্কালঙ্কারের মতে, বাঙালির জীবনে বিপ্লব যদি কোথাও ঘটে থাকে তবে তা রান্নাঘরে। তিনি নিজেই নব্যন্যায়ের চর্চা ছেড়ে ডুব দিয়েছিলেন রন্ধন শিল্পে। এই দুই সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের লেখাতেই মাংসের এক মহাকাব্য। ‘পাক রাজেশ্বর’-এ ‘প্রলেহ’ অর্থাৎ কোর্মা তৈরির প্রণালী উল্লেখ করেছেন। আছে ভেড়া, কচ্ছপ, হরিণ, খরগোশ রান্নার বিভিন্ন পদও। তিলের তেল দিয়ে ছাগলের মাথা ও নাড়ি রান্নার পদ্ধতি দিয়েছেন বিশ্বেশ্বর। গৌরীশঙ্করের ‘ব্যঞ্জন রত্নাকর’-এ আছে মাংস পরিষ্কারের কথা— ‘লোমসহ চর্ম্ম দূর করণের পর উদরসহ মূত্র পুরীষ ও পিত্তস্থলী এবং নাড়ি ইত্যাদি ত্যাগ করিবে, পরে ওষ্ঠ দন্ড চক্ষূ কর্ণ ক্ষুর ও চরণ আদি ত্যাগ করিবে।’ গরমমশলা, আদা, পেঁয়াজ ও ঘি সহযোগে নাড়ি রান্নার পদ্ধতিও এই বইতে আছে। আছে মাংস দিয়ে করলা বা বেগুনের শুক্ত প্রলেহ, মাংস দিয়ে লাউ অথবা ঝিঙে, কাঁচা আম, আনারস বা কলার পোলাও, শসা বা কাঁকুড়ের শাঁস বার করে তাতে মাংসের পুর ভরে কাবাব ইত্যাদি।