Advertisement
E-Paper

চার মাথার আইনস্টাইন মোড়ে ‘নিষিদ্ধ’ আলোকবিন্দু! ঘাবড়ে গেলেন বিজ্ঞানীরা, নেপথ্যে কি ব্রহ্মাণ্ডের সেই ভূতুড়ে বস্তু?

সম্প্রতি এই তত্ত্ব ‘দ্য অ্যাস্ট্রোফিজ়িক্যাল জার্নাল’-এ প্রকাশ করেছেন গবেষকেরা। তাঁদের মত, এই ব্রহ্মাণ্ডে ডার্ক ম্যাটার কোথায় কোথায় লুকিয়ে রয়েছে, তার খানিক আভাস পাওয়া গেল মাত্র। ভবিষ্যতে এর থেকে ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জানা যেতে পারে বলেও আশাবাদী তাঁরা।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৯:০৩
আইনস্টাইন ক্রস।

আইনস্টাইন ক্রস। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

ব্রহ্মাণ্ডে আলোর চার বিন্দু দিয়ে চতুষ্কোণ তৈরি হলে সেটাকে ‘চার মাথার আইনস্টাইন মোড়’ বলেই ধরে নেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বুঝে যান, নিশ্চয়ই সেখানে কোনও নক্ষত্রমণ্ডল রয়েছে। কিন্তু সে রকমই এক চতুষ্কোণের মাঝখানে ধরা পড়ল আরও এক আলোকবিন্দু! যা দেখে রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

মহাকাশ সব সময়েই চতুর্মাত্রিক। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা নিয়ে তার স্থান (স্পেস)। সঙ্গে রয়েছে সময় (টাইম)। এই চতুর্মাত্রিক ব্রহ্মাণ্ডে কোনও মহাজাগতিক বস্তুর টান থাকে আর একটি মহাজাগতিক বস্তুর উপর। একেই বলা হয় ‘গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্স’ বা অভিকর্ষ বল। সেই বল আলোর পথও বাঁকিয়েচুরিয়ে দেয়।

‘জেনারেল রিলেটিভিটি’ তত্ত্বে (সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ) এ কথাই বলেছিলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। বলেছিলেন, মাস বা ভর তার চার পাশের শূন্যস্থানকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। আলো ভরবিহীন শূন্যস্থানে সোজাপথে চলে। কিন্তু ভরের কারণে শূন্যস্থানই যদি দুমড়ে-মুচড়ে যায়, তা হলে আলো‌ও বাঁকা পথে চলবে।

মোদ্দা কথা, ব্রহ্মাণ্ডের স্থান ও কাল (‘স্পেস টাইম’) সোজাসরল নয়। তা অত্যন্ত বক্র (‘কার্ভড’)। তাই তার ভিতর দিয়ে আলোর কণা ফোটনও চলে আঁকা-বাঁকা পথে। সেই বক্র স্থান-কালে আরও একটি মহাজাগতিক বস্তু এসে পড়লে, তা আরও বক্র হয়ে পড়ে। কারণ, মহাজাগতিক বস্তুরও জোরালো অভিকর্ষ বল রয়েছে। তখন আলোর কণার পথ আরও বেঁকেচুরে যায়।

ব্রহ্মাণ্ডে খুব দূরে থাকা বস্তু মহাকাশে থাকা বিভিন্ন টেলিস্কোপের চোখে ধরা পড়ে ওই অভিকর্ষ বল আর তার জেরে আলোর পথ বেঁকেচুরে যাওয়ার ফলেই। তার ফলে, অনেক দূরের আলোও আমাদের চোখে ধরা দেয়। সামনে কোনও মহাজাগতিক বস্তু এসে পড়লে তা অনেকটা আতশকাচের মতো কাজ করে। দূরের আলোকে টেনে নিয়ে আসে কাছে। তাকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে তোলে। খুব দূরে থাকা বস্তুরও আকার বাড়িয়ে দেয় বহু গুণ। জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে, ‘গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং’। এই লেন্সিংয়ের কারণেই আলো কখনও কখনও চারটি বিন্দুতে ভাগ হয়ে যায়, যা দেখতে অনেকটা ক্রসের লাগে। তাই একে ‘আইনস্টাইন ক্রস’ বলা হয়। টেলিস্কোপে এই দৃশ্য ধরা পড়লে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বুঝে যান, ওই চার আলোকবিন্দুর মাঝে কোনও নক্ষত্রমণ্ডল রয়েছে।

ঠিক এই ভাবেই ‘হারএস-৩’ নামে এক নক্ষত্রমণ্ডলের সন্ধান মিলেছে। আইনস্টাইনের কথামতো চার আলোকবিন্দু খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সব হিসাব গড়বড় করে দিল ওই চার বিন্দুর মাঝে ‘নিষিদ্ধ’ এক আলোকবিন্দু! নিষিদ্ধ কারণ, ওই আলোর বিন্দু সেখানে থাকারই কথা নয়!

‘ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চ’-এর একদল গবেষকের চোখে প্রথম এই দৃশ্য ধরা পড়ে। ওই গবেষক দলের নেতৃত্বে থাকা পিয়ের কক্স বলেন, ‘‘প্রথম বার দেখে তো চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। ভেবেই পাচ্ছিলাম না যে, ওই আলোর বিন্দুটা এল কোত্থেকে? এই জিনিস এর আগে কখনও দেখিনি।’’

গবেষকেরা এখনও পর্যন্ত মহাকাশের যত দূর পর্যন্ত পৌঁছোতে পেরেছেন, তার শেষ প্রান্তে ‘হারএস-৩’ নক্ষত্রমণ্ডলটি রয়েছে বলে অনুমান বিজ্ঞানীদের। প্রায় ১১৭০ কোটি আলোকবর্ষ (আলো এক বছরে যে পথ অতিক্রম করে) দূরে। পঞ্চম আলোকবিন্দু দেখে প্রাথমিক ভাবে কক্সদের মনে হয়েছিল, হয়তো কোনও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে চার বিন্দুর মাঝে একটি আলোকবিন্দু দেখা যাচ্ছে! কিন্তু অঙ্ক কষে, বার বার পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাঁরা দেখলেন, এটা কোনও যান্ত্রিক ত্রুটি নয়। ওখানে সত্যিই একটি পঞ্চম আলোকবিন্দু রয়েছে। কক্সদের বক্তব্য, এর একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে। তা হল— নিশ্চয়ই সেখানে কোনও ‘ডার্ক ম্যাটার’ রয়েছে!

আমাদের চারপাশে গাছপালা, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, গ্রহ-উপগ্রহ, ছায়াপথ-সহ যে সমস্ত দৃশ্যমান জড় পদার্থগুলি দেখা যায়, তারা এই মহাবিশ্বের মোট ভরশক্তির ৫ শতাংশ মাত্র। বাকি ৯৫ শতাংশ সম্পূর্ণ অদৃশ্য। অজানা। রহস্যময় এক অন্ধকার জগৎ। তার মধ্যে ৭০ শতাংশই হল অদৃশ্য শক্তি (জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে ডার্ক এনার্জি)। আর ২৫ শতাংশ ডার্ক ম্যাটার।

ব্রহ্মাণ্ডের সব নক্ষত্রমণ্ডলই ঘুরছে লাট্টুর মতো। আশ্চর্য, অত জোরে ঘুরেও কিন্তু তারা অটুট। অভিকর্ষ বল নক্ষত্রমণ্ডলের মধ্যে নক্ষত্রদের টেনে রাখার কাজ করে বটে। কিন্তু লাট্টুর ঘোরার যে গতি, তাতে সেই টান উপেক্ষা করে নক্ষত্রদের দিগ্বিদিকে ছিটকে পালানোর কথা। তা ঘটছে না কেন? বিজ্ঞানীদের অনুমান, ভেলকি দেখাচ্ছে এই ডার্ক ম্যাটার, যা চেনা যায়নি আজ পর্যন্ত। সে রকম পদার্থের অভিকর্ষ বল নাকি বাড়তি আকর্ষণ-বল জুগিয়ে আঁটসাঁট ভাবে বেঁধে রেখেছে সব নক্ষত্রমণ্ডলকে।

এই ডার্ক ম্যাটারের শুধু অস্তিত্বটুকুই বিজ্ঞানীদের জানা। এটুকুও পরিষ্কার যে, তারা ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন চরিত্রের নয়। কিন্তু তার উৎস কী, কী দিয়ে তৈরি, তা এখনও সম্পূর্ণ অজানা। শুধু বোঝা যায় যে, আলোর সঙ্গে এই সব ভূতুড়ে পদার্থের কিছু একটা শত্রুতা রয়েছে। সে আলো শোষণ করে না। আলো প্রতিফলন, প্রতিসরণ বা বিচ্ছুরণ কিছুই করে না। ফলে একে দেখাও যায় না। কিন্তু কক্সদের বক্তব্য, ব্রহ্মাণ্ডের এই ভূতুড়ে বস্তুরা আর কিছু না-করুক, তবে এর অভিঘাতে ‘স্পেসটাইম’ দুমড়ে-মুচড়ে যাবে। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়, ডার্ক ম্যাটারের প্রবল অভিকর্ষ বলে শূন্যস্থান এমন ভাবে বেঁকেচুরে গিয়েছে যে, একটি পঞ্চম আলোর বিন্দু তৈরি হয়েছে।

সম্প্রতি এই তত্ত্ব ‘দ্য অ্যাস্ট্রোফিজ়িক্যাল জার্নাল’-এ প্রকাশ করেছেন কক্সরা। তাঁদের মত, এই ব্রহ্মাণ্ডে ডার্ক ম্যাটার কোথায় কোথায় লুকিয়ে রয়েছে, তার খানিক আভাস পাওয়া গেল মাত্র। ভবিষ্যতে এর থেকে ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জানা যেতে পারে বলেও আশাবাদী গবেষকেরা।

Albert Einstein
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy