মর্মান্তিক: বাড়ির দরজার সামনেই গুলি করা হয় সিকন্দরকে। নিজস্ব চিত্র
সদর দরজার মুখে চাপ চাপ রক্ত। আর সেই রক্ত ছুঁয়েই বসে আছেন সদ্য স্বামী হারানো তরুণী আর সন্তান হারানো প্রৌঢ়া। তাঁদের ঘিরে আছেন প্রতিবেশীরা।
ভাটপাড়ার বড় শ্রীরামপুরের বাসিন্দা সিকন্দর দাস (৩৫) শনিবার রাতে খুন হন বাড়ির সামনেই। তাঁর পরিবার ও প্রতিবেশীদের অভিযোগ, স্ত্রী ও মায়ের সামনেই পেটে ওয়ান শটার ঠেকিয়ে সিকন্দরকে গুলি করে মনোজ সাউ ওরফে মন্নু নামে এলাকারই এক বাসিন্দা। সঙ্গে ছিল সুনীল সাউ নামে আর এক জন। পুলিশ রবিবার সুনীলকে গ্রেফতার করেছে। মন্নু অবশ্য এখনও ফেরার। ব্যারাকপুর কমিশনারেটের ডিসি (উত্তর) শ্রীহরি পাণ্ডে বলেন, ‘‘সুনীল ধরা পড়েছে, মন্নুর খোঁজ চলছে। আরও কয়েক জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে।’’
কিন্তু সিকন্দর খুনের ঘটনায় দু’টি প্রশ্ন তুলছেন প্রশাসনের কর্তা থেকে সচেতন নাগরিক, সকলেই। প্রথমত, প্রাথমিক তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী পাওনা টাকা না পাওয়াই খুনের কারণ। তাঁর ছেলের থেকে মন্নু ও সুনীল যথাক্রমে ১০ এবং ২০ হাজার টাকা পেত বলে জানিয়েছেন সিকন্দরের মা সুমিত্রা দাস। টাকা না পেয়ে সিকন্দরকে খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ। এত সহজেই পরিচিত কাউকে খুন করে ফেলার প্রবণতা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। বছরের পর বছর ধরে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে আগ্নেয়াস্ত্রের সহজলভ্যতা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। সূত্রের খবর, মন্নু, সুনীল, সিকন্দর— এদের কারও অপরাধের রেকর্ড নেই পুলিশের খাতায়। মন্নুর প্রতিবেশীরা এ দিন জানান, সে ইটভাটার শ্রমিক। নিজেই ধারদেনা করে সিকন্দরকে সাহায্য করেছিল বছর দেড়েক আগে। পাড়ায় কোনও দিন কাউকে মারধর করতেও দেখা যায়নি যাকে, সে-ই আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে এক জনকে খুন করে ফেলবে, এটা আশ্চর্যের— বলছেন পড়শিরাই।
পরিবার সূত্রের খবর, প্রথম লকডাউনের আগে ব্যাগ তৈরির ব্যবসা শুরু করতে চেয়েছিলেন সিকন্দর। নিজের জমানো পুঁজি ও পরিচিতদের থেকে টাকা ধার করে সরঞ্জাম কিনেছিলেন। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির জেরে সেই ব্যবসা শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়ে। সুমিত্রাদেবী বলেন, ‘‘সিকন্দরের এক ব্যবসার সঙ্গী আত্মহত্যা করেন দেনা মেটানোর আতঙ্কে। ছেলে ধৈর্য ধরতে বলত সবাইকে। মন্নুরা বার বার টাকা চাইত। শনিবার রাতে আমার সামনে ছেলেটাকে মেরে ফেলল।’’
তদন্তকারীরা জানান, ব্যবসা ডুবে যাওয়ায় বিভিন্ন চটকলে শ্রমিকের কাজ করছিলেন সিকন্দর। যেটুকু আয় হত, তাতে সংসারের খরচ কুলোত না। ধার শোধ করতে যে সময় লাগবে, সেটাও তিনি মন্নুদের বলতেন। মৃতের পরিবারের দাবি, মাঝেমধ্যেই দুই অভিযুক্ত বাড়িতে চড়াও হত। ফোনেও হুমকি দিত। ঘটনার কিছু ক্ষণ আগেই কাজে বেরিয়েছিলেন সিকন্দর। কিন্তু টিফিন আর গামছা নিতে ভুলে যাওয়ায় স্ত্রী নীতু তাঁকে ফোন করেন। সিকন্দর ফিরে জিনিসপত্র নিয়ে ফের যখন রওনা দিতে যাচ্ছিলেন, তখনই মন্নু আর সুনীল হাজির হয় বলে জানিয়েছেন নীতু। তিনি বলেন, ‘‘ভেবেছিলাম মন্নুরা ওকে চড়-থাপ্পড় মারবে হয়তো। কিন্তু মেরেই ফেলল এই টাকার জন্য!’’
ঠিক এই প্রশ্নটাই ভাবাচ্ছে পুলিশের মানসিক বিকাশের জন্য গঠিত ‘ওয়েলনেস সেন্টার’-এর কাউন্সেলর, আধিকারিকদের। ভাটপাড়া, কাঁকিনাড়া, জগদ্দল, টিটাগড় বা কামারহাটিতে এমন ঘটনা নতুন নয়। ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের যুগ্ম কমিশনার (সদর) ধ্রুবজ্যোতি দে বলেন, ‘‘শুধু ধরপাকড় করে পরিস্থিতি বদলাবে না। সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। করোনায় রোজগারহীন হয়েছেন অনেকে। পেশা বদলে গিয়েছে অনেকের। এমন বহু সিকন্দর হয়তো গোটা শিল্পাঞ্চল জুড়ে আছেন। তাঁদের সুরক্ষিত রাখতে হবে আমাদের।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy