Advertisement
E-Paper

‘তৃণমূলের লোককে হঠাতে’ আইএনটিইউসি-র মাথায় রমেন পাণ্ডে, সোমেন-প্রদীপ দুই মেরুতে

প্রায় সব রাজ্যে আইএনটিইউসির পাল্টা কমিটি গঠিত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গেও তেমনটাই হল। বুধবার কলা মন্দিরে পাল্টা সম্মেলন করে রমেন পাণ্ডেকে সভাপতি ঘোষণা করল সংগঠনের একটি অংশ। ফলে রাজ্য আইএনটিইউসি-তে আপাতত দু’জন সভাপতি— কামারুজ্জামান কামার এবং রমেন পাণ্ডে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৭:০১
গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।

একটি সংগঠন। দু’জন সভাপতি। বিরল পরিস্থিতির মুখোমুখি রাজ্য আইএনটিইউসি। কংগ্রেসের এই শ্রমিক সংগঠনের রাজ্য সভাপতি পদে আগে থেকেই ছিলেন কামারুজ্জামান কামার। বুধবার আবার সংগঠনের সভাপতি হিসেবে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করা হল রমেন পাণ্ডের নাম। অর্থাৎ, এই মুহূর্তে রাজ্য আইএনটিইউসি-র সভাপতি দু’জন। রমেন পাণ্ডেদের সম্মেলনে আবার হাজির হলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রর পুত্র রোহন। ফলে শ্রমিক সংগঠনের দখলকে কেন্দ্র করে সোমেন মিত্র এবং প্রদীপ ভট্টাচার্যের মধ্যে টানাপড়েন শুরুর ইঙ্গিতও স্পষ্ট হয়ে গেল।

সভাপতি নিয়ে আইএনটিইউসি-র এই গোলমালের সূত্রপাত সংগঠনের কেন্দ্রীয় স্তরে। কয়েক দশক ধরে এই সংগঠনের জাতীয় সভাপতি পদে আছেন জি সঞ্জীব রেড্ডি। এখন তাঁর বয়স নব্বই। রেড্ডিকে আর আইএনটিইউসির শীর্ষপদে চাইছেন না রাহুল গাঁধী। খবর কংগ্রেস সূত্রের। কিন্তু অন্যান্য শ্রমিক সংগঠনকে যে ভাবে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল, আইএনটিইউসির উপরে কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ সে রকম নিরঙ্কুশ নয়। আইএনটিইউসি অনেকটাই স্বশাসিত। সেই কাঠামোকে হাতিয়ার করেই কংগ্রেস নেতৃত্বের ইচ্ছা-অনিচ্ছা অগ্রাহ্য করে ইউপিএ জমানায় তিন বার মনমোহন সিংহের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিল আইএনটিইউসি। এখনও কংগ্রেস নেতৃত্বের পছন্দ-অপছন্দ অগ্রাহ্য করেই রেড্ডি আঁকড়ে রয়েছেন সংগঠনের শীর্ষপদটি। কিন্তু পাল্টা স্রোতও বইতে শুরু করেছে সংগঠনের অন্দরে। রেড্ডিকে সভাপতি হিসেবে মানতে অস্বীকার করে পাল্টা সম্মেলন হয়েছে জাতীয় স্তরে। সেই সম্মেলন থেকে ঝাড়খণ্ডের শ্রমিক নেতা চন্দ্রশেখর দুবেকে আইএনটিইউসির জাতীয় সভাপতি ঘোষণা করা হয়েছে। কে আসল সভাপতি রেড্ডি, না দুবে, তা নির্ধারণের মামলা আদালত পর্যন্ত গড়িয়ে গিয়েছে। আপাতত রেড্ডি এবং দুবে সমান্তরাল ভাবে সাংগঠনিক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন।

বিভিন্ন রাজ্যে আইএনটিইউসি সভাপতি এবং অন্যান্য পদাধিকারী হিসেবে যাঁদের অনুমোদন দিয়েছিল রেড্ডি গোষ্ঠী, তাঁদের এখন মানতে চাইছেন না দুবে-পন্থীরা। প্রায় সব রাজ্যে আইএনটিইউসির পাল্টা কমিটি গঠিত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গেও তেমনটাই হল। বুধবার কলা মন্দিরে পাল্টা সম্মেলন করে রমেন পাণ্ডেকে সভাপতি ঘোষণা করল সংগঠনের একটি অংশ। ফলে রাজ্য আইএনটিইউসি-তে আপাতত দু’জন সভাপতি— কামারুজ্জামান কামার এবং রমেন পাণ্ডে।

কামারুজ্জামানের আগে রমেন পাণ্ডেই রাজ্য আইএনটিইউসির সভাপতি ছিলেন। রমেন অনুগামীরা জানাচ্ছেন, চার বছরের সভাপতিত্বে আইএনটিইউসির ছাতার তলায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন তিনি, যার সংখ্যা অন্তত ১৪৮। রমেন পাণ্ডে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে বাংলা থেকে লেভি পাঠিয়েছিলেন ৩১ লক্ষ টাকা, যা নজিরবিহীন বলে রমেন শিবিরের দাবি। রমেন বললেন, ‘‘অন্ধ্র এবং তেলঙ্গানা মিলিয়ে রেড্ডি ১৫ লক্ষ টাকা লেভি দিতে পেরেছিলেন। ঝাড়খণ্ড (দুবের রাজ্য) দিতে পেরেছিল ১৩ লক্ষ টাকা। আর যে পশ্চিমবঙ্গে আমাদের দল চার দশক ক্ষমতার বাইরে, সেখান থেকে আমরা ৩১ লক্ষ টাকা লেভি দিয়েছিলাম।’’

আরও পড়ুন: প্রশাসনের একাংশের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছু লোক আর মাফিয়া এ সব করছে’

রমেন শিবির বলছে, এই সাফল্যে ‘ঈর্ষান্বিত’ ছিলেন রাজ্য আইএনটিইউসির অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা তথা কংগ্রেস সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য, রেড্ডিও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছিলেন। তাই তড়িঘড়ি রমেনকে সরিয়ে প্রদীপ অনুগামী কামারুজ্জামান কামারকে রাজ্য আইএনটিইউসির সভাপতি পদে বসিয়ে দেওয়া হয় বলে আইএনটিইউসির একটি অংশ দাবি করছে। আর বুধবার আনন্দবাজারকে রমেন পাণ্ডে নিজে বলেন, ‘‘কামারুজ্জামান কামারকে সভাপতি হিসেবে শ্রমিকরা কেন মানবেন? উনি তো তৃণমূলের লোক। বেলেঘাটায় প্রকাশ্য মঞ্চে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা গিয়েছিল তাঁকে, তিনি তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। সেই কামারুজ্জামান কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠনের রাজ্য সভাপতি হবেন কী ভাবে!’’ রমেন এ দিন সরাসরি নিশানা করেন প্রদীপ ভট্টাচার্যকে। তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূলের বিধায়কদের ভোট নিয়ে রাজ্যসভায় জয়ী হয়েছেন প্রদীপ ভট্টাচার্য। তার বিনিময়ে আইএনটিইউসি-কে তৃণমূলের ঘরে গ্যারেজ করে দিতে চাইছেন তিনি। সেই কারণেই তৃণমূলের লোক কামারুজ্জামানকে সভাপতি পদে বসিয়ে দিয়েছিলেন।’’

আইএনটিইউসির এই বিরোধকে কেন্দ্র করে প্রদেশ কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ চোরাস্রোতও কিন্তু ফের সামনে চলে এসেছে। প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য এখনও কামারুজ্জামানের পাশেই। কিন্তু প্রদেশ কংগ্রেসের বর্তমান সভাপতি সোমেন মিত্রর সমর্থন রমেন পাণ্ডের দিকে— এমন জল্পনা জোরদার হয়েছে। রমেনদের সম্মেলনে এ দিন যাওয়ার কথাও ছিল সোমেনের। শেষ পর্যন্ত তিনি যাননি। যান সোমেনের ছেলে তথা প্রদেশ যুব কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রোহন মিত্র। এ দিন কলা মন্দিরে আয়োজিত সম্মেলনে রোহন ভাষণও দেন। কংগ্রেসের বিরোধিতা নয়, আইএনটিইউসি-কে কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে হবে— রোহন এই বার্তাই দেন।

রোহন মিত্র নিজে অবশ্য আনন্দবাজারকে জানিয়েছেন, শুধু রমেন পাণ্ডেদের সম্মেলনে নয়, এ দিন কামারুজ্জামান কামারের একটি কর্মসূচিতেও তিনি যোগ দিয়েছেন। আইএনটিইউসি সভাপতি পদে কে থাকবেন, তা নিয়ে তাঁর কোনও মতামত নেই বলেও রোহন দাবি করেছেন। কিন্তু যে সম্মেলন থেকে রমেন পাণ্ডেকে রাজ্য আইএনটিইউসির একটি অংশ সভাপতি হিসেবে ঘোষণা করছে, সেই কর্মসূচিতে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির ছেলের উপস্থিতি যে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে, সে বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একমত।

আরও পড়ুন: আর চাইবে না, এলাকায় যাও, বিধায়কদের ধমক মমতার

অধীর চৌধুরীকে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি পদ থেকে সরানোর দাবিতে সোমেন-প্রদীপরা এক সময়ে একসুরে দরবার করেছিলেন রাহুল গাঁধীর কাছে। কংগ্রেস নেতারাই তেমনটা দাবি করেন। সোমেন মিত্র প্রদেশ কংগ্রেসের নতুন সভাপতি হওয়ায় প্রদীপ উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করেছিলেন। প্রদেশ কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ সমীকরণে সোমেনের ঘনিষ্ঠ হিসেবেই প্রদীপের পরিচিতিও ছিল। কিন্তু প্রদেশ সভাপতি পদে সোমেন কয়েক মাস কাটাতেই তাঁর বিরোধিতার বলয়ও প্রসারিত হতে শুরু করেছে বলে বিধান ভবন সূত্রের খবর। আইএনটিইউসির নেতৃত্বকে ঘিরে সোমেন এবং প্রদীপ দুই মেরুতে চলে যাওয়ার আভাসে সেই নতুন সমীকরণই স্পষ্ট হলে বলে রাজনৈতিক শিবিরের মত।

আরও পড়ুন: রথযাত্রার মুখে টক্করে তৈরি দু’পক্ষ

সোমেন মিত্র অবশ্য কোনেও বিভাজন বা বিরোধিতার কথা স্বীকার করেননি। রমেন পাণ্ডেকে যে তিনি পছন্দই করেন, কথায়-বার্তায় তা বুঝিয়ে দিয়েছেন সোমেন। কিন্তু পাশাপাশি এও বলেছেন যে, ‘‘আমি আর প্রদীপ ভট্টাচার্য আলাদা নই।’’

আর প্রদীপ গোষ্ঠীর শ্রমিক নেতা তথা কামারুজ্জামানের কমিটির সাধারণ সম্পাদক তপন ঘোষ বলেছেন, ‘‘সভাপতি পদে রমেন পাণ্ডের নিয়োগের কোনও বৈধতা নেই। চন্দ্রশেখর দুবে নিজেও বৈধ সভাপতি নন। সভাপতি জি সঞ্জীব রেড্ডি-ই। তাই দুবে কাকে রাজ্য আইএনটিইউসির সভাপতি হিসেবে নিয়োগ করলেন, তাতে কিছুই যায় আসে না।’’

(বাংলার রাজনীতি, বাংলার শিক্ষা, বাংলার অর্থনীতি, বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার স্বাস্থ্য, বাংলার আবহাওয়া -পশ্চিমবঙ্গের সব টাটকা খবর আমাদের রাজ্য বিভাগে।)

INTUC Somen Mitra Pradip Bhattacharya Ramen Pandey Pradesh Congress
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy