Advertisement
E-Paper

যে ভাবে অসুর নিধন করে দুষ্টের বিনাশ করেছিলেন মা দুর্গা, আমার মেয়ের খুনিকেও যেন সে ভাবেই ফাঁসিকাঠে চড়ান তিনি!

ছোট্ট থেকে শান্ত স্বভাবের, খুব কম কথা বলা, বাড়ির লক্ষ্মী মেয়েকে অকালে হারিয়ে পুজোর সব কিছুই গুলিয়ে ফেলেছে গোটা পরিবার। এ বাড়িতে পুজোর আগমনী ছিল না। এ বাড়িতে পুজোর বিজয়া দশমীও নেই। তবে ঈশ্বরে আস্থা আর বিশ্বাস এখনও রয়েছে কুসুমের।

প্রণয় ঘোষ

শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২৫ ০৭:৫৫
Ishita Mullik death Case: Like maa Durga the law should punish the Asura man who is the culprit in the Krishnanagar incident, hopes the girl\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\'s mother

ঈশিতা মল্লিক। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

কয়েকশো মিটারের মধ্যে মানিকপাড়ার বারোয়ারি পুজোমণ্ডপ। সেখানে স্পষ্ট উচ্চারণে চণ্ডীপাঠ হচ্ছে। কিন্তু মল্লিকদের ‘আশাভিলা’য় সেই আওয়াজ বড় ফিকে। বড্ড ক্লান্ত। কিছুটা দুর্বোধ্যও। এ বাড়ির বিষণ্ণতা স্তোত্রের সমস্ত গমক গিলে খেয়েছে।

আসলে দুটো বুলেট পুজোর পরিপার্শ্ব থেকে এই বাড়িকে ছিটকে দিয়েছে। একটা গুলি মাথার পিছনে। অন্যটা চোয়ালে। পুলিশি পরিভাষায় ‘পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ’ থেকে। তার পর থেকেই আশ্বিনের শারদপ্রাতে আর কোনও কিছু স্বাভাবিক ছন্দে চলছে না এই বাড়িতে। এ বাড়িতে তাই পুজোর গন্ধ নেই। শব্দ নেই। আনন্দ নেই।

এ বছর এ বাড়িতে পুজোর আগমনী ছিল না। তাই এ বাড়িতে বৃহস্পতিবার পুজোর বিজয়া দশমীও নতুন করে আসবে না।

কৃষ্ণনগর প্রশাসনিক ভবন থেকে কয়েকশো মিটার দূরে উইমেন্স কলেজ। কলেজের গেট ছাড়িয়ে জাতীয় সড়কের দিকে একটু এগোলেই ডান হাতে আকাশি রঙের ‘আশাভিলা’। সে বাড়িরই মেয়ে ঈশিতা মল্লিক।

ঈশিতার ঘর খুলতে পুলিশের বারণ। তবে পুলিশ ঘর ‘সিল’ করেনি। বহু আর্জিতে মেয়ের ঘরের দরজা খুললেন দুলাল মল্লিক। অনুরোধ করলেন, ‘‘কিছুতে হাত দেবেন না। ওরা বারণ করেছে।’’ দরজা খুলতেই একটা গুমোট, ভ্যাপসা ভাব ঠেলে বাইরে এল। ঈশিতার বাবা দুলাল বলছিলেন, ‘‘প্রতি বছর এই সময়টায় ঘর জুড়ে থাকত নতুন জামা-জুতোর গন্ধ।’’ ঘরের ভিতরে সাদা ফুলছাপ আলমারিটা হাট করে খোলা। হ্যাঙার থেকে ঝুলছে জামাকাপড়। তাকে সাজানো পোশাক। ‘মেকআপ বক্স’। অনাদরে পড়ে কালো আর খাকি রঙের দু’টি চামড়ার ব্যাগ। আলমারির ভিতরের দিকের পাল্লায় ঝুলছে গত বছরে কেনা কালো রোদচশমা। ঠাসাঠাসি করে সাজগোজের জিনিস।

এই ঘরেই খুন হয়েছিলেন সাড়ে আঠারোর ঈশিতা। গত ২৫ অগস্ট। দুপুর আড়াইটে নাগাদ পর পর দু’টি গুলির শব্দ শুনতে পান প্রতিবেশীরা। দেখা যায়, ঈশিতার ঘর থেকে রক্ত গড়িয়ে আসছে। কারও ডাকেই সাড়া দেননি নিথর ঈশিতা। চিৎকারে ছুটে আসেন প্রতিবেশীরা। খবর যায় পুলিশে। তাদের গাড়িতেই গুলিবিদ্ধ ঈশিতাকে যথাসম্ভব দ্রত নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। তত ক্ষণে সব শেষ!

ঘটনার কয়েকদিন পরে ঈশিতাকে খুনের অভিযোগে দেশরাজ সিংহ নামে এক যুবককে উত্তরপ্রদেশ থেকে গ্রেফতার করে এনেছে পুলিশ। সেই ‘আততায়ী’ আপাতত জেলবন্দি।

বাড়ির দোতলায় শোয়ার ঘরের দরজা খুললে খাওয়ার জায়গা। তার পাশে বসার ঘর। সেখানে লম্বা সোফার কোণ ঘেঁষে রাখা কম্পিউটার টেবিল। গোটা বাড়ির মধ্যে এটিই ছিল ঈশিতার সবচেয়ে প্রিয় আস্তানা। পুজোর দিনগুলোতে এখানেই বেশির ভাগ সময় কাটত তাঁর। টেবিলে কালো রঙের মনিটর। নীচে সিপিইউ। কিপ্যাড ট্রে-র উপরে রাখা একটা হেডফোন। পাশে মাউস।

অব্যবহারে ঝুল জমেছে কম্পিউটারের স্ক্রিনে। মাউসে নাছোড় ধুলো। মনিটরের উপর গোটা বাড়িতে নজরদারি চালানোর জন্য সিসিটিভি স্ক্রিন। বিটিএসের অন্ধ ভক্ত ঈশিতার গান শোনার হেডফোনে এখন মাকড়সার বাসা। ধুলোমাখা কালো মাউসে হাত দিয়ে নিকষ কালো মনিটরের দিকে তাকিয়ে দুলাল বললেন, ‘‘কালো রং ওর বড্ড প্রিয়। চিৎকার করে কাঁদতে পারি না! নীরবে আকাশের দিকে তাকাই। কন্যাদান করব ভেবেছিলাম। সেই মেয়ের পিণ্ডদান করেছি নিজের হাতে। সেই অভাগা বাবার জীবনে কি উৎসব মানায়?’’

কেনাকাটা করতে ভালবাসতেন ঈশিতা। দুলাল বললেন, ‘‘গত বার মহালয়ার আগেই ওর মা আর আমাকে সঙ্গে নিয়ে কয়েক ডজন দোকান ঘুরে কিনেছিল কালো রঙের দুটো কুর্তা আর ডেনিম। জুতো কোথাও পছন্দ হচ্ছিল না। আমার বাইকে চড়ে চষে ফেলেছিল গোটা কৃষ্ণনগর। পঞ্চমীর দুপুরে মাকে সঙ্গে নিয়ে কিনে নিয়ে এসেছিল কালো সানগ্লাসটা।’’ দামি জিনিস কেনার জন্য মাঝেমধ্যেই মায়ের কাছে ধমক শুনতেন। কিন্তু ঈশিতা নাছোড়। ‘‘ছোট্ট থেকে সাজতে ভালবাসা মেয়ের পুজোর সময়ে স্পেশ্যাল মেকআপ কিটের আবদার পূরণের ভরসা ছিলাম আমিই। আমার বাইকের পিছনে বসে ব্যাগভর্তি সাজার জিনিস নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল গত বার।’’ বলতে বলতে আবার দু’চোখ ভরে জল এল দুলালের।

অন্যান্য সাড়ে আঠারোর তুলনায় অবশ্য একটু ঘরকুনো ছিলেন ঈশিতা। সন্ধ্যা হওয়ার পর ব্যালকনিতে বসে ঠাকুর দেখার ভিড় দেখতেন। মণ্ডপে প্রতিমা আসার আগে আঁকার খাতায় ফুটে উঠত দুগ্গাঠাকুরের মুখ। মহালয়া পেরোতেই শুরু হয়ে যেত সাজের মহড়া। সাজা শেষ হলে বার কয়েক ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে ছুটে যেতেন নীচে ঠাকুরদা-ঠাকুরমার ঘরে। দুলালের কথায়, ‘‘আমার বাবা-মা প্রশংসা না-করলে যেন সব সম্পূর্ণ হত না। ওঁদের প্রশংসা পেলে আনন্দে ছুটে আসত উপরের ঘরে।’’ শারীরিক অসুস্থতা আর অকালমৃতা নাতনির শোকে শয্যাশায়ী ঠাকুরদা জয়দেব মল্লিক। শুধু বললেন, ‘‘একগাদা স্মৃতি নিয়ে বসে আছি। বর্তমান বলে তো আর কিছু নেই। সব শেষ করে দিয়ে গিয়েছে ওই ছেলেটা। একটা অসুর! আমাদের মা দুগ্গাকে শেষ করে দিয়ে গেল।’’ বৃদ্ধের কথা জড়িয়ে আসে। বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে অস্ফুটে বলেন, ‘‘এক এক বার এক একটা জামা আর বিভিন্ন কায়দায় সাজ। সাজ হলেই ছুটতে ছুটতে আসত আমার কাছে, কেমন হয়েছে দাদু? বলতাম, এত সুন্দর যে চেনাই যাচ্ছে না! হাসিমুখে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যেত। আবার কিছু ক্ষণের মধ্যে ফিরে আসত নতুন সাজে। পুজোর আগের ক’টা দিন এ ভাবেই চলত।’’

‘আশা ভিলা’ যাঁর নামে, সেই আশারানি মল্লিক এ বার আর ছেলে দুলালকে নারকেল কিনে আনতে বলেননি। প্রতিবেশীর বাড়িতে নারকেল চাইতেও যাননি। ঈশিতা নাড়ু খেতে ভালবাসতেন। ঈশিতা আর নেই। তাই নাড়ুর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। প্রতি বার পুজোর আগে থেকে চলত নারকেল আনার কাজ। তার পর কোরানো। চিনি দিয়ে মাখা। কড়াইয়ে ফেলে ‘ছেঁই’ তৈরি। দু’হাতের তালুর মধ্যে একটু একটু ছেঁই নিয়ে গোল্লা পাকানো। এর পর সেগুলো চালান হয়ে যেত কাচের বয়ামে। ভর্তি বয়াম রাখা থাকত আশারানির ঘরে। ষষ্ঠী থেকে বড় জোর নবমী— সব নাড়ু শেষ! ঈশিতা একাই দায়িত্ব নিয়ে শেষ করতেন। ঘরে বসে সেই ফাঁকা বয়ামগুলোর দিকে আঙুল তুললেন আশারানি, ‘‘কার জন্য করব! যে ভালবেসে সব ফাঁকা করে দিত, সে-ই তো নেই! কার জন্য রেখে দেব লুকিয়ে! আর নাড়ু বানাব না। কোনও দিনও না।’’

মাঝেমধ্যেই মায়ের কাছে চাইনিজ় খাওয়ার বায়না করতেন ঈশিতা। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ‘এঁচোড় বিরিয়ানি’ রান্না হত পুজোর সময়েই। অসময়ে এঁচোড় খুঁজে পেতে হিমশিম খেতেন বাবা দুলাল। তাই গত বছর বাড়ির পিছনের ফাঁকা জায়গায় সারা বছর ফল দেওয়া একটা কাঁঠাল গাছ পুঁতেছিলেন মা কুসুম। বর্ষার জলে পুষ্ট হয়ে নতুন শাখাপ্রশাখা ছড়িয়েছে সে গাছ। কিন্তু যার জন্য কাঁঠাল গাছের বেড়ে ওঠা, তাঁর বড় হওয়া তো থেমে গিয়েছে। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলছিলেন কুসুম।

আর আছে করণ। ঈশিতার ভাই। সারা বছর দিদির সঙ্গে তার নানা খুনসুটি। তবে পুজোর দিনগুলো আলাদা। কার ক’টা জামা হল, দিদির সঙ্গে বসে বার বার গুনত। এ বছর দিদি নেই। এক বারের জন্যও ‘পুজো’ শব্দটা শোনা যায়নি অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া করণের মুখে। ওর মুখে শুধুই ‘ছোড়দি’। বার বার গিয়ে দাঁড়াচ্ছে দিদির ছবির সামনে। গত বছর সপ্তমী থেকে শুরু হয়েছিল দিদি আর ভাইয়ের ঠাকুর দেখা। বাবার বাইকে চেপে সপ্তমীর সন্ধ্যায় মা-দিদি আর করণ গিয়েছিল নবদ্বীপে। অষ্টমীতে পারিবারিক রীতি মেনে বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো। সে দিন সকালে মায়ের হাতে-হাতে জোগাড় দিয়েছিলেন দিদি ঈশিতা।

ছোট্ট থেকে শান্ত স্বভাবের, খুব কম কথা বলা, বাড়ির লক্ষ্মী মেয়েকে অকালে হারিয়ে পুজোর সব কিছুই গুলিয়ে ফেলেছে গোটা পরিবার। করণও। গত বছরের নবমী-দশমী মা-দিদির সঙ্গে কেটেছিল বাড়ির কাছের বারোয়ারিতে। আর এ বার? করণ বলল, ‘‘দিদিই তো সব চেয়ে বেশি আনন্দ করত। বাবাকে রাজি করিয়ে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেত। এ বার কার সঙ্গে যেতাম? দিদি যখন নেই, তখন ঠাকুরও নেই!’’

এ বছরে এ বাড়িতে পুজোর আগমনী ছিল না। তাই এ বার এ বাড়িতে পুজোর বিজয়া দশমীও নেই।

তবে ঈশ্বরে আস্থা আর বিশ্বাস এখনও রয়েছে কুসুমের। সেই বিশ্বাসে ভর করে তিনি বলছেন, ‘‘মা দুর্গা যেমন অসুরবধ করে গোটা স্বর্গরাজ্যে দেবতাদের প্রতি অন্যায়ের প্রতিশোধ নিয়েছিলেন, আমার বিশ্বাস তিনি সে ভাবেই মেয়ের খুনিকে ফাঁসিকাঠে চড়িয়ে চরমতম শাস্তি দেবেন।’’

student murder Bhinno Pujo
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy