এ বছরের অক্টোবর মাসে কলকাতার আকাশে ঘনিয়ে এসেছিল দূষণের কালো ছায়া। বিগত আট বছরের তুলনায় ২০২৫ সালের অক্টোবরে শহরের বায়ুমান সূচক সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছিল। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি এন্ড ক্লিন এয়ার (সিআরইএ)-এর এক সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ জানাচ্ছে, ওই মাসে সূক্ষ্ম ধূলিকণার ঘনত্ব বিপজ্জনক মাত্রায় বেড়েছিল, যা গত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি। তবে পরিবেশ দফতরের তরফে দাবি করা হয়েছে, অক্টোবর মাস কেটে যাওয়ার পর নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহেই দূষণের মাত্রা অনেকটাই কমে গিয়েছে কলকাতা শহর জুড়ে।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে কলকাতায় শুরু হয়েছিল শারদোৎসব। এর পর অক্টোবর মাসেই একের পর এক উৎসবে মেতে থেকেছে কলকাতা। দুর্গাপুজো শেষ হওয়ার পরে লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, দীপাবলি এবং ছট উৎসবকে কেন্দ্র করে কলকাতা শহরের প্রায় সব প্রান্তেই কমবেশি দূষণ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি দূষিত হয়েছে কলকাতার বাতাস। কারণ, এই সব উৎসবকে কেন্দ্র করে যে ভাবে আতশবাজি পুড়েছে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে, তাতে দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক বলে মনে করছে পরিবেশ দফতরের একাংশ। বিশেষ করে কালীপুজো ও দীপাবলির দিন বিকেল থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত যে পরিমাণ আতশবাজি পোড়ানো হয়েছে, তাতে বাতাসে দূষণের পরিমাণ দ্রুত হারে বেড়ে গিয়েছে। তবে পরিবেশ বিশেষজ্ঞেরা আতশবাজির সঙ্গে যানবাহনের চলাচলের সংখ্যাকেও বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন। তাঁদের মতে, এই পরিস্থিতির অন্যতম কারণ উৎসবকালীন সময়ের অতিরিক্ত দূষণ। দীপাবলি ও কালীপুজোর সময় শহর জুড়ে যেমন আতশবাজি পোড়ানো হয়, তেমনই পাল্লা দিয়ে যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি পায় এবং তাপমাত্রা হ্রাস পায়— সব মিলিয়ে বাতাসের মানের দ্রুত অবনতি ঘটে। ২০২৫-এর অক্টোবরের বায়ু দূষণের মাত্রা অন্য বছরের থেকে বেশি ছিল বলে দাবি করা হয়েছে ওই রিপোর্টে।
পাশাপাশি তাঁদের আরও বক্তব্য, উৎসবের সময় আতশবাজির ব্যবহার এবং যানবাহনের চলাচল বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ‘এয়ার ইনভার্শন’ প্রক্রিয়াও বড় ভূমিকা রাখছে। ‘ইনভার্শনে’র ফলে ঠান্ডা বাতাস উপরের স্তর থেকে নীচে নেমে আসে এবং নীচের উষ্ণ বায়ুর সঙ্গে মিশে যেতে না পারায় ধূলিকণাগুলি স্থির হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের পর বর্ষা শেষ হওয়ায় বাতাসে আর্দ্রতা কমে, ফলে ধুলো ও দ্বিতীয় পর্যায়ের দূষণের উপাদান বাতাসে ছড়িয়ে থাকে দীর্ঘ সময়। সিআরইএ-র তথ্য অনুসারে, অক্টোবর মাসে কলকাতার বায়ুমান সূচক ‘গুড’ বা ‘স্যাটিসফ্যাক্টরি’ মাত্রায় থাকা দিনের সংখ্যা কমে গিয়েছিল আশঙ্কাজনক ভাবে।
পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্রের প্রশ্ন, ‘‘অক্টোবর মাসে শহরের বায়ু দূষণের পরিমাণ বেড়েছে। এর জন্য দায়ী কারা? সব কিছুই কি সরকার-প্রশাসনের উপর হাতে ছেড়ে দিলে হবে? সাধারণ মানুষের কি কোন দায় দায়িত্ব নেই? আতশবাজি না ফাটিয়ে কি উৎসব উদ্যাপন করা সম্ভব নয়?’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘গত ৮ বছরে কলকাতার বাতাসে দূষণের পরিমাণ অনেকটাই কমে গিয়েছে। কিন্তু অক্টোবর মাস জুড়ে উৎসব উদ্যাপনের নাম করে শহর কলকাতায় সাধারণ মানুষ যা করেছে, তাতে দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। সরকার অবশ্যই পদক্ষেপ করবে, আমদের তরফে সরকারপক্ষ বা কলকাতা পুরসভাকে বেশ কিছু পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই কলকাতা বিভিন্ন জায়গায় দু’বার করে জল ছিটিয়ে ধূলিকণাকে স্তিমিত করার চেষ্টা শুরু হয়েছে। এ ভাবেই অনেক পদক্ষেপ করা হয়েছে, তবে রাজ্যের মানুষ সচেতন না হলে দূষণের পরিমাণ কোনও সরকারের পক্ষে কমানো সম্ভব নয়। সরকার ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের মতো কলকাতাবাসী তথা রাজ্যের মানুষকে সচেতন হয়েই বায়ুদূষণ থেকে রক্ষা করতে হবে।’’
আরও পড়ুন:
২০২৫ সালের অক্টোবরে মাত্র ৮ দিন ‘গুড’, ১৫ দিন ‘স্যাটিসফ্যাক্টরি’ এবং বাকি ৮ দিন ‘মডারেট’ ছিল। সিআরইএ-র বিশ্লেষকেরা আরও বলছেন, এটি শুধু উৎসব-পরবর্তী সাময়িক সমস্যা নয়। অক্টোবরের শুরু থেকেই বাতাসের মান নিম্নমুখী হতে শুরু করেছিল। তাঁদের আশঙ্কা, শীত যত এগোবে, দূষণের মাত্রা ততই বাড়বে, কারণ, শীতকালে বাতাস স্থির হয়ে থাকে এবং দূষণকণিকা মাটির কাছেই আটকে যায়। পরিবেশবিদেরা মনে করছেন, কলকাতার মতো মহানগরে বায়ুদূষণ এখন শুধুমাত্র মৌসুমি সমস্যা নয়, বরং এক স্থায়ী সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহরের যানবাহনের ধোঁয়া, নির্মাণকাজ, শিল্পাঞ্চলের নির্গমন ও অগ্নিদূষণ একত্রে বাতাসের মান দ্রুত নামিয়ে দিচ্ছে।
তবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আসন্ন শীতে কলকাতা ও শহরতলিতে দূষণ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। তাই নাগরিকদের উচিত ঘরের বাইরে কাটানোর সময় সীমিত রাখা, বিশেষত যাঁদের হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট বা কাশি রয়েছে। ঘরে বিশুদ্ধ বাতাসের প্রবাহ রাখা এবং প্রয়োজনে মাস্ক ব্যবহার করাও গুরুত্বপূর্ণ।
যদিও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ মনে করছে, নভেম্বরের গোড়া থেকে দূষণের মাত্রা অনেকটা কমে গিয়েছে। তবে নাগরিকদের সচেতন থাকতেই হবে।