আগামী বিধানসভা ভোটে ভবানীপুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারাবেন বলে ইতিমধ্যেই একাধিক বার চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন শুভেন্দু অধিকারী। কিন্তু সে লড়াই যখন আর মেরেকেটে ১০ মাস দূরে, তখন গোটা দক্ষিণ কলকাতা জুড়ে বিজেপি ব্যস্ত ‘মুষলপর্বে’ ব্যস্ত। জেলা সভাপতি নিজের এলাকায় নিজের দলের কর্মীদের হাতে আক্রান্ত হচ্ছেন। ‘সক্রিয় সদস্যপদ’ থেকে বহু কর্মীকে বঞ্চিত রাখার অভিযোগ উঠছে। জেলা কমিটি আড়াই মাস ধরে গঠন করা যায়নি। কমিটি গঠনের যে ‘ফর্মুলা’ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বেঁধে দিয়েছেন, তা জেলা সভাপতি মানতে রাজি হচ্ছেন না বলে একাংশের দাবি। সে সবের মাঝে আবার আর এক নেতা হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, মোক্ষম সময়ে ‘ব্রহ্মস’ ছুড়বেন!
এ বারের সাংগঠনিক নির্বাচন পর্বে উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতায় সভাপতি বদল করেনি বিজেপি। উত্তরে তমোঘ্ন ঘোষ এবং দক্ষিণে অনুপম ভট্টাচার্যকে রেখে দেওয়া হয়েছে। সভাপতি পদে তাঁদের বহাল রাখার ঘোষণা গত মার্চে করেছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। কিন্তু জুনের প্রথম সপ্তাহ কাটিয়ে ফেলেও তমোঘ্ন, অনুপমেরা নিজেদের কমিটি গড়তে পারেননি। দক্ষিণে ‘গোদের উপরে বিষফোড়া’ অনবরত অশান্তি। সভাপতি পদে ‘পুনর্নির্বাচিত’ হওয়ার জন্য সংবর্ধনা নিতে গিয়ে নিজের এলাকা বেহালায় মার্চ মাসে আক্রান্ত হন অনুপম। সেই ঘটনার জেরে বিজেপি চার জনকে দল থেকে ‘বরখাস্ত’ও করে। কিন্তু তাতে ক্ষোভের আঁচ কমেনি। লাগাতার চলছে অভ্যন্তরীণ অশান্তি। সাম্প্রতিকতম ঘটনা কেন্দ্রীয় সহ-পর্যবেক্ষক অমিত মালবীয়ের উপস্থিতিতে দু’পক্ষের হাতাহাতি এবং ধস্তাধস্তি।
দলে যাঁরা অনুপমের শিবিরে নন, তাঁদের ‘সক্রিয় সদস্যপদ’ পাওয়া অনুপম নিয়ম ভেঙে আটকে দিয়েছেন বলে দক্ষিণ কলকাতার বিজেপি কর্মীদের একটি অংশের দাবি। দলের যে কর্মীরা অন্তত ৫০ জনকে ‘প্রাথমিক সদস্য’ হিসেবে নথিভুক্ত করাতে পারবেন, তাঁরা ‘সক্রিয় সদস্যপদ’ পাবেন বলে বিজেপি নেতৃত্ব সংগঠন পর্বের শুরুতেই ঘোষণা করেছিলেন। সে মাপকাঠিতে যাঁরা সফল, তাঁদের অনেককে ‘সক্রিয় সদস্য’ হতে দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ। এঁদের মধ্যে কয়েক জন আবার ওই সাংগঠনিক জেলায় ‘ওজনদার’ নাম। আলিপুর চত্বরের প্রভাবশালী মুখ রাকেশ সিংহ, জেলা বিজেপির প্রাক্তন সহ-সভাপতি ওঙ্কারনাথ চক্রবর্তী, প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক সঞ্জু দাশগুপ্ত, বেহালা অঞ্চলের প্রাক্তন মণ্ডল সভাপতি দিব্যেন্দু সামন্ত, ইন্দ্রনাথ দুয়ারি-সহ বেশ কিছু নাম দক্ষিণ কলকাতার বিজেপি কর্মীদের মুখে মুখে ফিরছে, যাঁদের ‘সক্রিয় সদস্য’ হওয়া অনুপম এবং বিদায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক জিতেন্দ্র সিংহ আটকে রেখেছেন বলে বিজেপির একাংশের অভিযোগ।
জেলা সভাপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ আরও রয়েছে। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, বুথ, মণ্ডল ও জেলা স্তরের নতুন কমিটিগুলিতে ৫০ শতাংশ সদস্য পুরনো কমিটি থেকে নিতে হবে। দক্ষিণ কলকাতার বিজেপি সভাপতি অনুপম সে নির্দেশিকাও নাকি মানতে নারাজ।
প্রশ্নের জবাবে অনুপম অভিযোগগুলির কোনওটিই পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারেননি। পুরনো কমিটি থেকে ৫০ শতাংশ সদস্যকে নতুন কমিটিতে জায়গা দিতে না চাওয়া প্রসঙ্গে তাঁর জবাব, ‘‘এগুলো দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ নিয়ে বাইরে কথা বলতে পারব না। আমি যা করছি, তা আমার উচ্চতর নেতৃত্ব দেখছেন। যদি নিয়ম মেনে না করে থাকি, তাহলে তাঁরা ব্যবস্থা নেবেন।’’ অনেককে ‘সক্রিয় সদস্য’ না-হতে দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘‘দিব্যেন্দু সামন্ত আর ইন্দ্রনাথ দুয়ারি দল থেকে এখন সাসপেন্ডেড (নিলম্বিত)।’’ রাকেশ, ওঙ্কারনাথ, সঞ্জুদের ‘সক্রিয় সদস্যপদ’ না-পাওয়ার অভিযোগের কোনও ব্যাখ্যা অনুপম দেননি।
বৃহস্পতিবার অনুপমের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে বিজেপি সূত্রের খবর। বুথ সশক্তিকরণ কর্মসূচিতে সে দিন দক্ষিণ কলকাতা সাংগঠনিক জেলায় হাজির ছিলেন কেন্দ্রীয় সহ-পর্যবেক্ষক মালবীয়। সঙ্গে রাজ্য নেতৃত্বের প্রতিনিধিরা। ওই কর্মসূচিতে রাকেশের দলবল রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতাদের হেনস্থা করতে পারে বলে রাজ্য নেতৃত্ব আশঙ্কা করেছিলেন। তাই এক বিধায়ক রাকেশকে ফোনে সতর্কবার্তা দেন। জেলা কার্যালয় থেকে কর্মসূচি স্থানান্তরিত করা হয় চেতলা রোডের কাছে ‘একান্ত আপন’ প্রেক্ষাগৃহে। রাকেশের দলবল শেষ পর্যন্ত সেখানে যায়নি। কিন্তু তাতেও অশান্তি ঠেকানো যায়নি। প্রাক্তন জেলা সহ-সভাপতি ওঙ্কারনাথের নেতৃত্বে একদল কর্মী সেখানে হাজির হন। তাঁদের ভিতরে ঢুকতে বাধা দেওয়া হলে ধস্তাধস্তি-হাতাহাতি শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত তাঁরা প্রায় সকলেই প্রেক্ষাগৃহে ঢোকেন। তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘আমরা ঢুকে দেখলাম অনুপম সেখানে নেই। রাজ্য স্তরের এক নেতা তার আগে পর্যন্ত ছিলেন। আমরা ঢোকার পরে তাঁকেও আর দেখা গেল না। কিন্তু মালবীয়জি আমাদের সঙ্গে কথা বলেন।’’ ওঙ্কারনাথ বলেন, ‘‘একমাত্র অমিত মালবীয়ই আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। আমাদের সব বক্তব্য মন দিয়ে শুনে পদক্ষেপ করবেন বলেও আশ্বস্ত করেছেন।’’
এর মধ্যে ‘তৃতীয় পক্ষ’ হয়ে ময়দানে নেমেছেন রাকেশ। বুধবার রাতে গাড়িতে বসে একটি ফেসবুক লাইভে তিনি বলেন, ‘‘আমি কলকাতা থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে আছি। কিন্তু রটানো হচ্ছে, কাল (বৃহস্পতিবার) বিজেপির কর্মসূচিতে রাকেশ সিংহের লোকজন গিয়ে গোলমাল করবে।’’ রাকেশ বলেছিলেন, ‘‘যে দিন আমার ঝামেলা করার দরকার হবে, বুক বাজিয়ে করব। এমন ব্রহ্মস মারব যে, দুনিয়া মনে রাখবে। তার জন্য যদি আজীবন কারাবাস হয়, হবে।’’ স্থানীয় বিজেপি কর্মীদের অনেকের দাবি, রাকেশ একাই প্রায় ৭৫০ জনকে ‘প্রাথমিক সদস্য’ করেছেন। ফেসবুক লাইভে রাকেশ তাঁদের সকলকে নিয়ে দল ছাড়ার হুমকি দিয়েছেন।
‘ভবানীপুর চ্যালেঞ্জের’ কথা মাথায় রেখে শুভেন্দু আপাতত দক্ষিণ কলকাতার গোলমাল দ্রুত মিটিয়ে নেওয়ার বার্তা পাঠাচ্ছেন বলে বিজেপি-র একটি সূত্রের দাবি। কিন্তু দক্ষিণ কলকাতার বিজেপি কর্মীদের একাংশের বক্তব্য, অনুপম এখন সমস্যা মেটানোর পরামর্শে কান দিচ্ছেন না। এক তরুণ কর্মীর কথায়, ‘‘অনুপমের দ্বিতীয় বার সভাপতি পদ পাওয়া নিশ্চিত ছিল না। রাজ্য বিজেপির দুই সর্বোচ্চ নেতার কেউই যাতে তাঁর নামে আপত্তি না করেন, তা নিশ্চিত করতে ওই দুই নেতার ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা দক্ষিণ কলকাতার একাধিক বিজেপি কর্মীকে অনুপম কাজে লাগান। তখন তাঁর হয়ে যাঁরা সুপারিশ করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখন অনুপমকে সমস্যা মেটানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু অনুপম কোনও কথা মানছেন না।’’