সৌগত এবং ফিরহাদ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কয়েক মাস আগেও তৃণমূলের অন্দরে ‘ভদ্রলোকের স্বর’ হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল। কিন্তু এখন সেই তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ের মুখেই প্রায় প্রতি দিন শোনা যাচ্ছে ‘কুকথা’! কখনও বিরোধীদের জুতোপেটা করার, কখনও গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে জুতো বানানোর, কখনও বা এলাকাছাড়া করার হুমকি দিচ্ছেন তিনি। দলের তরফে প্রকাশ্যে এত দিন তার নিন্দাও শোনা যায়নি। কিন্তু শনিবার সেই ‘নিয়মের’ ব্যতিক্রম ঘটালেন দলের দাপুটে মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম।
শুক্রবার দক্ষিণ দমদম পুরসভার একটি কর্মসূচিতে বিরোধীদের নিশানা করে প্রাক্তন অধ্যাপক সৌগত বলেন, ‘‘পার্থের (চট্টোপাধ্যায়) বিরুদ্ধে বলুন কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু ভুল করে এ কথা বলবেন না তৃণমূলের সকলে চোর। তা হলে কিন্তু পিঠে তাল পড়লে দুঃখ করবেন না।’’ অভিযোগ, ‘পিঠে তাল’ বলে আসলে সরাসরি বিরোধীদের শারীরিক নিগ্রহে উস্কানি দিয়েছেন দমদমের তৃণমূল সাংসদ। কারণ, ওই কর্মসূচিতেই বিজেপি-সিপিএম-কংগ্রেসকে ‘অপপ্রচার’ না চালানোর হুঁশিয়ারি দিয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘‘এই সব বললে আমাদের ছেলেরা রেগে যায়। রেগে গেলে মানুষের মাথা ঠিক থাকে না! কী করবে আমি বলতে পারছি না।’’
তার পরেই শনিবার ফিরহাদ সরাসরি সৌগতের ‘লাইন’ থেকে দূরে সরার বার্তা দিয়েছেন। সৌগতের মন্তব্য থেকে দূরত্ব তৈরি করে জানিয়েছেন, তৃণমূল ‘গাঁধীবাদী’ দল। বিরোধীদের উপর হামলার রাজনীতিতে তারা বিশ্বাস করে না। প্রসঙ্গত, রাজ্যের মন্ত্রী এবং কলকাতার মেয়র ফিরহাদ তৃণমূলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটিরও অন্যতম সদস্য। ফলে এ ক্ষেত্রে তাঁর মন্তব্য ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করছেন তৃণমূলের একাংশ। এই পরিস্থিতিতে সৌগতের মুখে দল ‘লাগাম পরায়’ কি না, সেটাই দেখার। যদিও তৃণমূল শিবিরের সকলেরই জানা যে, দলের অন্দরে সৌগতের সঙ্গে ফিরহাদের সম্পর্ক ততটা ‘মসৃণ’ নয়। ফলে ফিরহাদের মন্তব্য দলের শীর্ষনেতৃত্বের ‘অবস্থানের’ অনুসারী না-ও হতে পারে বলে তৃণমূলের একাংশের দাবি। ঘটনাচক্রে, ‘গাঁধীবাদী’ ফিরহাদ তাঁর অভিমত প্রকাশের আগে বলে রেখেছেন, সৌগত ঠিক কী বলেছেন, তা তিনি জানেন না।
সৌগত অবশ্য ইতিমধ্যেই তাঁর মতো করে কুকথা-কাণ্ডের ‘ব্যাখ্যা’ দিয়েছেন। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেছেন, ‘‘আমি মনে করছি বিজেপিকে একটু ঠান্ডা রাখা দরকার। ওরা বড্ড বেশি বলছে। তাই এমন ভাষা।’’ কিন্তু তাঁর মতো প্রাক্তন অধ্যাপক তথা প্রবীণ সাংসদ সৌগতকে তো সচরাচর এমন ভাষা ব্যবহার করতে দেখা যায় না! সৌগতের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘সব ভাষাই আনন্দবাজার অনলাইনের মতো সুশব্দ হবে এমন কি কোনও কথা আছে?’’
বস্তুত, এই বিতর্কের আবহে সৌগত নিজেকে ‘প্রাক্তন অধ্যাপক’ পরিচয়ের মধ্যে আটকেও রাখতে চাননি। তিনি বলেন, ‘‘যখন মনে হয় দরকার, তখন বলি। রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী ভাষা বদলায়।’’ প্রশ্ন ছিল, বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষের মুখে নানা শব্দের ব্যবহার শুনে তো তিনি তার নিন্দা করেন। জবাবে সৌগত বলেন, ‘‘দিলীপ ঘোষ অন্য কোনও ভাষা জানেন না। উনি তো লেখাপড়াই শেখেননি। আমি ভাল ভাষাও বলতে পারি। আক্রমণাত্মক ভাষাও বলতে পারি।’’
তবে ইদানীং তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তিনি যে খানিক সঙ্কুচিত তা-ও স্বীকার করেন সৌগত। তবে তার জন্যই যে এমন ভাষা ব্যবহার, তা মানতে নারাজ তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘লজ্জা একটু পাচ্ছি। তবে সেই লজ্জা থেকে এই ভাষা মুখে আসছে না। বিজেপি যে স্লোগান তুলছে ‘চোর ধরো, জেল ভরো’ সেটা আমার গায়ে লাগছে।’’ এই খারাপ লাগা থেকেই কি ‘কুকথা’? সৌগত বলে, ‘‘খারাপ তো লাগছে। তার জন্য হচ্ছে কি না, সে ব্যাখ্যা দিতে পারব না। তবে ভাষার উপরে আমার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। যখন যেমন দরকার পড়বে, তখন তেমন ভাষায় বলব।’’
সৌগতর মুখে অসৌজন্যের ভাষা সাম্প্রতিক কালে প্রথম শোনা যায় গত ১৪ অগস্ট। কামারহাটিতে একটি দলীয় কর্মসূচিতে তিনি বলেছিলেন, ‘‘তৃণমূলের সমালোচকদের গায়ের চামড়া দিয়ে পায়ের জুতো তৈরি হবে। তৃণমূলের সব চোর বলে মিছিল করলে পার্টি অফিসে ঢুকে যেতে হবে।’’ সেই মন্তব্য নিয়ে সমালোচনার মধ্যেই ২২ অগস্ট খড়দহে প্রবীণ সাংসদ বলেন, ‘‘যে দোষ করেছে, তার শাস্তি হবে। কিন্তু সবাইকে ‘চোর’ বললে আমরাও রুখে দাঁড়াব। উপযুক্ত শিক্ষা দেব। চোর না হয়ে বদনাম শুনতে পারব না।’’ কুকথার ধারা বজায় রেখে ২৭ অগস্ট কামারহাটিতে সৌগত বলেন, ‘‘সিপিএম, বিজেপি যদি আমাদের ‘চোর’ বলে উত্ত্যক্ত করে, তা হলে কিন্তু তৃণমূল কর্মীরা চুপ করে বসে থাকবে না। আমরা এক বার রুখে দাঁড়ালে ওদের এলাকাছাড়া হতে হবে।’’ অথচ এ সব কথা বলার ক’দিন আগেই অনুব্রত মণ্ডলের গ্রেফতার প্রসঙ্গে বীরভূমের কয়েক জন নেতা ‘কুকথা’ বলায় এই সৌগতই বলেছিলেন, ‘‘দল এ সব সমর্থন করে না।’’
তৃণমূলের পুরনো নেতা-কর্মীদের একাংশ অবশ্য বলছেন, প্রায় এক দশক আগে থেকেই ধীরে ধীরে ‘আক্রমণাত্মক’ ভাষা রপ্ত করেছেন সৌগত। ২০১৩ সালে একটি সভায় বলেছিলেন, ‘‘সিপিএম মায়ের ভোগে গিয়েছে। চট করে বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা নেই। হেরো মালদের দিয়ে সভা করাবেন না।’’ তাঁর সেই মন্তব্য ঘিরে বিতর্কও হয়েছিল। রাজ্যের কয়েক জন বিজেপির নেতার নাম করে ‘বাঁদর’ বলতেও শোনা গিয়েছে তাঁকে। নরেন্দ্র মোদী সরকারের জমানায় বেশ কয়েক বার লোকসভার অধিবেশনে ‘অসংসদীয়’ শব্দ ও ভাষা ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। সভার কার্যবিবরণী থেকে তা বাদও দিতে হয়েছে। কিন্তু গত মাস থেকে তাঁর বক্তৃতায় অশিষ্ট ভাষার প্রয়োগ নতুন মাত্রা পেয়েছে। উঠেছে অশান্তিতে উস্কানি দেওয়ার অভিযোগও।
সরাসরি কুকথার প্রয়োগ না করলেও গত কয়েক মাসে সৌগতের একাধিক মন্তব্য দলকে বিড়ম্বনায় ফেলেছে। চলতি বছরের গোড়ায় ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরের সংস্থা আইপ্যাকের সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্কে ‘জটিলতা’ তৈরি নিয়ে জল্পনার সময় তিনি বলেছিলেন, ‘‘আইপ্যাকের সঙ্গে কী চুক্তি ছিল আমি জানি না। সেই চুক্তি ভেঙে গিয়েছে। ক্ষতি না হলেও এতে অসুবিধা তো হবেই। পশ্চিমবঙ্গে এ বার তৃণমূলের জয়ের জন্য উল্লেখযোগ্য অবদান আইপ্যাকের।’’ এর পরেই তৃণমূল শীর্ষনেতৃত্বের নির্দেশে সৌগতকে ফোন করে ‘মুখ খুলতে বারণ করা হয়েছিল।’
এর পর নজরুল মঞ্চে এসে বলিউডের গায়ক কেকে-র মৃত্যুর পর প্রাক্তন অধ্যাপক সৌগত তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি) পরিচালিত ছাত্র সংসদের ‘টাকার উৎস’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। বরাহনগরে টিএমসিপিরই একটি কর্মসূচিতে বলেছিলেন, ‘‘এই যে কেকে গান গাইতে এসে মারা গেলেন! আমি শুধু ভাবি যে, এত টাকা কোথা থেকে এল! ৩০ লাখ না ৫০ লাখ কত যেন লেগেছে শুনলাম! টাকা তো হাওয়া থেকে আসে না।’’
তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ মনে করছেন, গত ২২ জুলাই পার্থের গ্রেফতারি থেকে শুরু হওয়া ঘটনাপ্রবাহের জেরে রাজ্য রাজনীতিতে যে টানাপড়েন শুরু হয়েছে, সৌগতর মতো প্রবীণ নেতার পক্ষে বোঝা উচিত ছিল। সম্ভবত তিনি পরিস্থিতির গুরুত্ব না বুঝেই অতিরিক্ত আগ্রাসী হয়ে উঠেছেন। তবে দলের অন্য একটি অংশের মতে সত্তরের দশকের উত্তাল সময়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব সামলানো সৌগত এতটা অবুঝ নন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নয়, ভেবেচিন্তে বা পরিকল্পিত ভাবেই ধারাবাহিক ভাবে এমন মন্তব্য করে চলেছেন তিনি। আর তাতে অনুমোদন রয়েছে শীর্ষনেতৃত্বর একাংশেরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy