বেঁটে লোকেরা সফল হলে আমার এমনিতেই খুব ভাল লাগে। তার বৈধ এবং ব্যক্তিগত কারণ আছে। হাজার হোক, সেই ছোটবেলা থেকে ‘বেঁটে-বেঁটে’ বলে আওয়াজ খেয়ে আসছি (ঠিকই খেয়েছি এবং এখনও খাই। সে সব ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছি। কী আর করা যাবে)। ফাজলামি করে একটা সময়ে বলতামও যে, পৃথিবীর ইতিহাস বলে, সব বেঁটে লোকই সফল। যেমন নেপোলিয়ন, চার্লি চ্যাপলিন, দিয়েগো মারাদোনা, সচিন তেন্ডুলকর, অনিল বিশ্বাস, আমি... ইত্যাদি, ইত্যাদি এবং ইত্যাদি।
সে সব একেবারেই ফালতু ইয়ার্কি। তবে ভগবান সংক্ষেপে সেরে দেওয়ায় একটু মনঃকষ্ট যে নেই, তা-ই বা কী করে বলি। সম্ভবত সেই কারণেই বেঁটে লোকেরা বড় যুদ্ধ জিতলে মনটা একেবারে তর হয়ে যায়।
যেমন হল টেম্বা বাভুমার জন্য। দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট দলের অধিনায়ক। আবডালে যাঁকে ‘কোটার ক্যাপ্টেন’ বলা হয়। হাসি-মশকরা করা হয়। সেই বাভুমার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রবল পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল জিতল (ম্যাচ শুরুর আগে ধারাভাষ্যকারদের মধ্যে দুই দক্ষিণ আফ্রিকান শন পোলক এবং গ্রেম স্মিথ ছাড়া কেউ বলেননি দক্ষিণ আফ্রিকা জিতবে। দুই ভারতীয় রবি শাস্ত্রী এবং দীনেশ কার্তিকও নন)। কোথায় জিতল? না ক্রিকেটের ধাত্রীগৃহ লর্ডসে। বাভুমার হাতে দক্ষিণ আফ্রিকার ফাইনালে হারের ‘চোকার্স’ তকমা মুছল। বেঁটে লোকের জীবনে এত ব়ড় জয় সিনেমা-টিনেমায় দেখা যায়। বাস্তবে? নাহ্, খুব একটা মনে পড়ছে না।
বয়স ৩৫ বছর। সে অর্থে ক্রিকেটার জীবনের সচ্ছল সময় পেরিয়ে এসেছেন। বিন্দুমাত্র গ্ল্যামার নেই। মাঠে খানিক উদাসীন দেখায় তাঁকে। সতীর্থ সহজ ক্যাচ ফেলে দিলেও কোনও বিরক্তিসূচক অঙ্গভঙ্গি করেন না। মুখের একটা রেখাও কাঁপে না। দেখতে ভাল নন। ফ্যাঁসফেঁসে গলা। একে গুরুনিতম্ব। তার উপর আবার এমন বেঁটে, যে কহতব্য নয়। দেখে মনে হয় জন্মের সময় কেউ একটা মাথায় চাপড় মেরে বনসাই বানিয়ে দিয়েছে। যখন সতীর্থ মার্কো জেনসেনের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলেন, অবিকল অরণ্যদেব কমিক্সের পিগমিদের সর্দার গুরানের মতো লাগে।

তিনি যখন মার্কো জেনসেনর সঙ্গে কথা বলেন। ফাইল চিত্র।
২০১৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টেস্ট অভিষেক তাঁর। ২০২১ সাল থেকে দেশের অধিনায়ক। কিন্তু মাঠের কোথাও কোনও উচ্চকিত উপস্থিতি নেই। লর্ডসে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসে একটা একটা করে উইকেট পড়ছিল আর দক্ষিণ আফ্রিকানরা সমবেত উৎসব করছিলেন। বাঘা বাঘা চেহারার ক্রিকেটারদের মধ্যে ক্যাপ্টেনকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হচ্ছিল। যখন জয়ের লক্ষ্যের কাছাকাছি এসে মহাকাব্যের নায়ক মার্করাম আউট, খুঁটে খুঁটে রান তুলছে দক্ষিণ আফ্রিকা, ধীরে ধীরে ব্যবধান কমছে, গ্যালারিতে উদ্বেল এবি ডিভিলিয়ার্স, বাভুমা তখনও নিশ্চল লর্ডসের বিখ্যাত ব্যালকনির চেয়ারে। ব্যাটাররা সিঙ্গলস নিচ্ছেন। তিনি নির্বিকার। এক স্ট্রোকে জয়ের রানে পৌঁছোতে অবিবেচকের মতো রিভার্স স্কুপ মারার চেষ্টা করলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটার (আম্পায়ার আউট দিলেন না। আল্ট্রাএজ দেখাল, বল গ্লাভস ছুঁয়ে কিপারের হাতে গিয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে অস্ট্রেলিয়ার ডিআরএস শেষ হয়ে গিয়েছে)। বাভুমা নিথর।
ঐতিহাসিক জয়ের রানটা এল অবশেষে। সতীর্থেরা লাফাচ্ছেন। ঝরঝর করে কাঁদছেন কেশব মহারাজ। কেউ কেউ তাঁকে এসে জড়িয়ে ধরছেন। বাভুমা তখনও চেয়ারে বসে। হাততালি দিচ্ছেন। কিন্তু পরিমিত। কোথাও কোনও উচ্ছ্বাস চোখে পড়ল না। হয়তো তাঁর বিশ্বাস হচ্ছিল না। কে জানে! অবশেষে চেয়ার ছেড়ে উঠল খর্বকায় চেহারাটা। ধীর পায়ে মিলিয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে।
আরও পড়ুন:
কিন্তু বাভুমার এই জয় তাঁর দৈহিক উচ্চতা নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে বিখ্যাত এবং অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে তাঁর দেশের বর্ণবৈষম্যের কদর্য অতীত ইতিহাস এবং সেই প্রেক্ষিতে তাঁর গাত্রবর্ণের কারণে। বাভুমা হলেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কালো ক্রিকেটার, যিনি দেশের মাটিতে টেস্ট সেঞ্চুরি করেছেন। তিনিই দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কালো ক্রিকেটার, যিনি দেশের অধিনায়ক হয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার যে তিন ক্রিকেটার একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে দেশের হয়ে অভিষেকেই সেঞ্চুরি করেছেন, বাভুমা তাঁদের একজন। এবং বাভুমা হলেন সেই কালো ক্রিকেটার, যাঁর অধিনায়কত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা দীর্ঘ ২৭ বছর পরে কোনও আইসিসি ট্রফি জিতল!
টেস্ট অধিনায়ক হিসাবে বাভুমার রেকর্ড ঈর্ষণীয়। এখনও হার নেই। লর্ডসের ফাইনালের আগে ৯টা টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে ৮টায় জয়। লর্ডসের জয় তাঁকে ১০-এ ৯ করল। কিন্তু গত ৮টা টেস্টের একটাও ‘ফাইনাল’ ছিল না। লর্ডস তাঁর ‘অপরাজিত’ খেতাব অক্ষুণ্ণ তো রাখলই, পাশাপাশিই তাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ইতিহাসে পাকাপাকি জায়গা করে দিল। পাশাপাশিই টেস্ট ক্রিকেটকে কি আরও একবার মহিমান্বিতও করল না?
ঘটনাচক্রে, প্রায় ২২ বছরের নির্বাসন শেষে দক্ষিণ আফ্রিকা যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরেছিল, তখন সেই প্রত্যাবর্তনের সিঁড়ির প্রথম ধাপে লেখা ছিল ইডেন গার্ডেন্সের নাম। ১৯৯১ সালের নভেম্বরে ইডেনে খেলেছিল আগুনে গতিসম্পন্ন অ্যালান ডোনাল্ড (২৯ রানে ৫ ইউকেট নিয়েছিলেন ‘হোয়াইট লাইটনিং’) সমৃদ্ধ সেই দক্ষিণ আফ্রিকা। ঘটনাচক্রেই সেই ঐতিহাসিক ম্যাচের খুচরো কভারেজের জন্য আনন্দবাজার পত্রিকার ক্রীড়া দফতর ধার নিয়েছিল আমাকে। ফলে যাকে বলে একেবারে রিংয়ের পাশ থেকে সেই টেস্ট ম্যাচ দেখেছিলাম। কিন্তু যে নাদান সাংবাদিক (টেনেটুনে তার এক বছর আগে পেশায় এসেছি। সবে শিক্ষানবিশি ঘুচে চাকরি পাকা হয়েছে) ম্যাচ দেখেছিল, সে আদ্যন্ত ক্রিকেটপিপাসু। নক্ষত্রদের কাছ থেকে দেখার নেশায় লোলুপ। জোরে শ্বাস টানলে সচিন-আজহারদের ঘেমো জার্সির গন্ধ পাওয়া যাবে, এমন দূরত্বে দাঁড়িয়ে কোনও এক সময়ে ক্রিকেটার হতে-চাওয়া সেই তরুণের তখন নোলা সকসক করছে। ফলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তনের ম্যাচে অংশ নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন অধিনায়ক ক্লাইভ রাইস যা বলেছিলেন (‘নিল আর্মস্ট্রং যখন চাঁদের মাটিতে প্রথম দাড়িয়েছিলেন, তখন তাঁর কেমন লেগেছিল আমি জানি’), তার মর্ম অনুধাবন করার মতো পরিস্থিতি তার ছিল না। কিন্তু মাঝের ৩৪ বছরে সে বর্ণবৈষম্যের অভিশাপকে আরও গভীর ভাবে বুঝেছে। সেই জন্য বাভুমার অগ্নিপরীক্ষা বুঝতে তার অসুবিধা হয় না। অসুবিধা হয়নি বুঝতে, যখন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক হয়ে বাভুমা বলেছিলেন, ‘‘আমি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কালো অধিনায়ক হওয়ার তাৎপর্য বুঝি। আমাদের দেশের যা ইতিহাস, তাতে দেশের মানুষ এটা উদ্যাপন করবেন, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এ-ও ঠিক যে, এই সম্মান আমায় আমার ক্রিকেটার জীবনের পুরো যাত্রাটার কথা বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে, যে কোথা থেকে কোথায় এসে পৌঁছেছি!’’
লর্ডসে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল নিয়ে ততটাই আগ্রহ ছিল, যতটা কবাডি নিয়ে বাঙালির থাকতে পারে। তৃতীয় দিন যখন অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে ২৮২ রান জয়ের লক্ষ্য খাড়া করল, মনে হয়েছিল, এই রে, আবার গেল দক্ষিণ আফ্রিকা! যারা প্রথম ইনিংসে ১৩৮ রানে বান্ডিল হয়েছে, তারা দ্বিতীয় ইনিংসে (ম্যাচের চতুর্থ ইনিংস) আর কী করবে এই কামিন্স-স্টার্ক-হেজ়েলউড নামক মহামহোপাধ্যায়দের সামনে!
কিন্তু ক্রিকেটে যে আবার নিশ্চয়তা বলে কিছু হয় না। মার্করাম-বাভুমা লড়াইটাকে একটা এমন অসাধারণত্বে তুলে নিয়ে গেলেন যে, সব ফেলে দেখতে বসে পড়লাম। এটা দেখতে যে, একটা দেশ, একটা জাতি ক্রিকেট ইতিহাসের দিকে কী করে পায়ে-পায়ে এগোচ্ছে এক এক ইঞ্চি করে, দাঁতে দাঁত ঘষে, চোয়াল শক্ত রেখে। হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট নিয়েও (রান নিতে গিয়ে খোঁড়াচ্ছিলেন) হাতের ব্যাটকে মশাল বানিয়ে সেই যাত্রার সামনের সারিতে একজন কালো মানুষ। গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। ব্যক্তিগত ২ রানের মাথায় স্লিপে স্টিভ স্মিথ তাঁর ক্যাচটা নিয়ে নিলে কী হত, বলা যায় না (ক্রিকেটদেবতাও বোধহয় কালো মানুষটির উপর করুণার্দ্র হয়েছিলেন। আর অস্ট্রেলিয়ার প্রতি বিরূপ)। কিন্তু তার পর থেকে বাভুমা স্পিন খেলেছেন আগে ব্যাট-পরে প্যাডের সনাতনী পদ্ধতিতে। তাড়াহুড়ো করেননি। দক্ষ শল্যচিকিৎসকের মতো লাগছিল তাঁকে। মার্করাম যখন বাঁ-পায়ের প্যাডের সামনে ড্রপ-পড়া ডেলিভারিটা জোরালো ফ্লিকে স্কোয়ার লেগ বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে সেঞ্চুরিতে পৌঁছোলেন, কমেন্ট্রি বক্সে উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়লেন নাসের হুসেন। ‘যাদুকরী ইনিংস’ বলছিলেন ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক। নন স্ট্রাইকার প্রান্ত থেকে পিচের মাঝখানে গিয়ে শিশুর মতো মার্করামের বুকে মুখ গুঁজলেন অধিনায়ক বাভুমা। মনে হচ্ছিল, ইনিংসের চেয়েও বেশি যাদুকরী ওই মুহূর্তটা।
সেরা হত, যদি চতুর্থ দিন জয়ের স্ট্রোকটা তিনিই নিতেন। অথবা জয়ের মুহূর্তে তিনি এবং মার্করাম মাঠে থাকতেন। বাভুমা-মার্করামের ২৫০ বলে ১৪৭ রানের পার্টনারশিপই তো দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্নসৌধকে। হল না। সেটা হলে সম্ভবত একটু বাড়াবাড়িও হত। ক্রিকেটদেবতাকে অতটা কাছাখোলা হতে নেই। আহত হ্যামস্ট্রিংই বাদ সাধল সম্ভবত। ৬৬ রানে থামলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ইতিহাসের নায়ক কালো মানুষ। যিনি এর পরে জাতীয় বীরের মহিমায় পূজিত হবেন। পুরস্কার বিতরণীর সময় তাঁর নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে লর্ডস জুড়ে যে জয়ধ্বনি উঠল (এবং নাসেরের সঙ্গে বাক্যালাপের সময় তাঁর প্রতিটি জবাবের সঙ্গে তার ডেসিবেল মাত্রা যে ভাবে ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকল), তা তেমনই জানান দিচ্ছিল।
আরও পড়ুন:
দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, বাভুমা নিজেই জানিয়েছিলেন, ঠাকুমা তাঁর নাম রেখেছিলেন ‘টেম্বা’। আফ্রিকান ভাষায় ‘টেম্বা’ শব্দের অর্থ ‘আশা’। সত্যিই। তিনি, টেম্বা বাভুমা, তাঁকে নিয়ে হাসি-তামাশা হলেও আশা ছাড়েননি। মনে পড়ছিল অধিনায়ক হওয়ার পর বাভুমার ওই কথাটাও, ‘‘কিন্তু আমি শুধুমাত্র এই পরিচয়ে (দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম অধিনায়ক, যাঁর গায়ের রং কালো) পরিচিত হতে চাই না। আমি চাই এমন এক ক্রিকেটার হিসেবে লোকে আমায় মনে রাখুক, যে তার দলকে দারুণ নেতৃত্ব দিয়েছিল। যে তার নেতৃত্বের নিজস্ব একটা ঐতিহ্য তৈরি করেছিল।’’
মনে হচ্ছিল, ফাজলামিতে আরও একটা নাম যোগ হল। এ বার কেউ ‘বেঁটে’ বললে বলতে হবে, পৃথিবীর ইতিহাসে সব বেঁটে লোকই সফল। যেমন নেপোলিয়ন, চার্লি চ্যাপলিন, দিয়োগো মারাদোনা, সচিন তেন্ডুলকর, অনিল বিশ্বাস, টেম্বা বাভুমা, আমি... ইত্যাদি, ইত্যাদি এবং ইত্যাদি।
না কি টেম্বা বাভুমাকে এই বন্ধনীতে আটকে রাখা যাবে না? তাঁর কীর্তির উচ্চতা অনেকটা বাড়িয়ে ফেলেছেন তিনি। ধরাছোঁয়ার বাইরে।