Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

পাল্টা আঘাত ফিরিয়ে দাও

শুক্রবারের মিছিল, এক কথায়, অভূতপূর্ব। এক রাতের নোটিসে চার হাজার লোকের জমায়েত, ভাবেননি ছাত্রছাত্রীরাও। আর প্রাক্তনরা? যেন মিছিলে-মিছিলেই দেখা।

আবাহন দত্ত
শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

বিকেল সাড়ে তিনটে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চার নম্বর গেটের বাইরে অকস্মাৎ গগনভেদী চিৎকার। ‘হোক হোক হোক কলরব’। ওই, সল্টলেক ক্যাম্পাস এসে পড়েছে। তিন ম্যাটাডর ছেলেমেয়ে, মাথায় লাল ফেট্টি, সঙ্গে লাল কাপড়ের ব্যানার।

শুক্রবারের মিছিল, এক কথায়, অভূতপূর্ব। এক রাতের নোটিসে চার হাজার লোকের জমায়েত, ভাবেননি ছাত্রছাত্রীরাও। আর প্রাক্তনরা? যেন মিছিলে-মিছিলেই দেখা। আজ কেউ দিল্লিতে, কেউ অস্ট্রিয়ায়। কিন্তু এ দিন যাঁরা কলকাতায় ছিলেন, সবাই যাদবপুরে। ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ দেখা, যেন আবিষ্কার, ‘আরে তুইও এখানে!’ কে যেন বলেই ফেলল, ‘সংস্কৃতি (যাদবপুরের ফেস্ট) নাকি?’

সংবাদমাধ্যমে শোনা যায়, বার বার নানা আন্দোলনে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে যাদবপুর। কিন্তু বৃহস্পতিবারের আক্রমণ ছিল নজিরবিহীন, কেননা সে দিন আগুন আর গর্ভে থাকেনি, আক্ষরিক অর্থেই জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছিল নিরীহ ইউনিয়ন রুমের নিয়ন বোর্ড, ক্যারম বোর্ড, সিলিং ফ্যান, কম্পিউটার, এমনকি সংলগ্ন তড়িৎদার দোকানও, যার চোদ্দোশো মাইলের মধ্যে কোনও রাজনীতি নেই।

বাবুল সুপ্রিয়েরও বলার অধিকার আছে, না কি ‘দাঙ্গাবাজ’কে শিক্ষাপ্রাঙ্গণে হিংসা ছড়াতে দেওয়া হবে না— এই মতবিরোধ নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সামান্য অস্বস্তি ছিল। কিন্তু ওটুকুই। এর পর সকলেই একমত। এখনও যদি গেরুয়া সন্ত্রাসকে ঠেকানো না যায়, তা হলে আর কবে, কোথায়, কী ভাবে? তাই বুধবার বিকেল অবধি ‘বিপ্লব করে কী হবে’ বা ‘রাজনীতি বুঝি না’ বলা ছেলেটি বা মেয়েটি আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসে গলার শির ফুলিয়ে বলেছে— ‘যব লাল লাল লহরায়েগা’। জোট বেঁধেছেন ছাত্র-গবেষক-শিক্ষক-কর্মচারীরা।

বিজেপি সরকার ইতিহাস বই পাল্টে ফেলছে, বিরোধীদের সভা করতে দিচ্ছে না, এনআরসি চালু করছে, সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়াচ্ছে— এই পর্বতপ্রমাণ অভিযোগের বিপরীতে কী আছে? কিছু ঠাট্টা, মিম। এবং অগাধ মৌন। অর্থাৎ যা দরকার, তা নেই। নেই বলেই ‘মৌনং সম্মতিলক্ষণম্’ ধরে তারা নির্দ্বিধায় ৩৭০ ধারা বাতিল করে দিল। কাল হয়তো আরও কিছু করবে। যাদবপুরের প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় জোরটা এখানেই, যে তা বুঝিয়ে দিয়েছে, প্রতিরোধ আছে। জেতা বা হারা পরের কথা। কিন্তু বিজেপি নেতা এসে যা-খুশি-তাই বলে চলে যেতে পারেন না। সাংবাদিক রবীশ কুমারের কথাটা মনে পড়তে পারে: ‘সব যুদ্ধে জেতার জন্য লড়া হয় না, যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ ছিল, এটা বোঝাতেও কিছু যুদ্ধে থাকতে হয়।’ তাই গেরুয়া বাহিনীও বুঝেছে, ওয়াক-ওভার নেই। তাই, অশুভ প্রক্রিয়া নিরন্তর চলমান হলে বিপরীত প্রতিক্রিয়াও চালাতেই হবে প্রতিনিয়ত। বলতে হবে, যা হচ্ছে তা ঠিক নয়। অতি-দক্ষিণপন্থীরা দেশ জুড়ে যা করছে, তা অন্যায়। আর যা হয়েছে তা-ও ঘোর বিপদের। যাদবপুর প্রাঙ্গণে ঢুকে যথেচ্ছাচার চালানো, জিনিসপত্র ভাঙচুর করা, ছাত্রছাত্রীদের আক্রমণ করা, উপাচার্যকে কটূক্তি করা বর্বরোচিত। সে বার্তাই ছিল পোস্টারে: ‘ভাজিনি চপ পুষিনি গরু/ আসল লড়াই এ বার শুরু’। গোটা দেশ অন্তত এটুকু দেখল যে প্রতিবাদ মরে যায়নি। এটাই ভরসার, স্বস্তির।

শুক্রবারের মিছিলের তারিখ-মাহাত্ম্য ছিল। ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ‘হোক কলবর’ মহামিছিল ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। পাঁচ বছরের ব্যবধান দেখাল, অটুট আছে পড়ুয়াদের সাহস-মাহাত্ম্যও। দলীয় দায় নেই, সহজ কথাটা সহজ ভাবে বলতে আসা, ভয় কিসের? আক্রান্ত ছাত্র পবন শুক্ল তো স্পষ্টই বার বার বলতে চাইল, ‘আমাদের কমিউনিস্ট বা নকশাল বলছেন কেন, আমরা কেবল সাধারণ ছাত্র!’

আর দুটো কথা শুক্রবার বুঝলাম। এক, সমাজে নিশ্চিত ভাবেই তীব্র মেরুকরণ আছে। বিজেপি-তৃণমূল নয়, হিন্দু-মুসলমানও নয়, শুভ-অশুভের মেরুকরণ। অশুভ যত শক্তিশালী হচ্ছে, তত দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া শুভ চেতনার মানুষ বুঝছেন, কী ভাবে তাঁদের ভিটেমাটি শেষ করে দিতে উদ্যত হয়েছে এক দল লোক। এবং দুই, পাঁচতারা লেখাপড়া মানে আসলে একটাই জিনিস শেখা: প্রশ্ন করার অধিকার। গোটা দেশের প্রায় সব শক্তি যেখানে আত্মসমর্পণ করে বসে আছে, সেখানে আগ্রাসী ভঙ্গিতে কথা বলেছে যাদবপুর। তুলনীয়, শত আক্রমণের পরেও জেএনইউ-এর বাম ছাত্রছাত্রীদের বিপুল জয়।

যাদবপুরে প্রতি মাসেই দুটো করে মিছিল হয়ে থাকে, নানা কারণে। সেখানে একটা মিছিল, তা-ও আবার পুজোর মুখে প্যাচপেচে গরমে, জনস্রোতে ভেসে গেলে বুঝতে হয়, এর তাৎপর্য কতটা। মিছিল যখন ঢাকুরিয়া ব্রিজের ওপর, তখন বিশ্বকর্মা ভাসান দিতে যাওয়া একাধিক ট্রাকও শুভেচ্ছা জানিয়ে গেল: ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ!’

অদ্ভুত এক দৃশ্যপট তৈরি করেছিল এই মিছিল। ফাইভ ট্রিলিয়ন ইকনমির চোটে গড়িয়াহাটের পুজোর বাজারে মন্দা। তা ছাপিয়ে বার বার জ্বলে উঠল কয়েক হাজার মোবাইল টর্চ, আর মুখরিত হল গোলপার্কের আইল্যান্ড: ‘যাদবপুর শিক্ষা দেয়, ডাক পাঠায়/ আঘাত যদি নেমেই আসে/ পাল্টা আঘাত ফিরিয়ে দাও।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

SFI BJP Jadavpur University Babul Supriyo
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE