Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
International News

ক্ষমতায় বসতে অন্য দলের দিকে তাকাতেই হচ্ছে ইমরানকে, এটা কীসের ইঙ্গিত?

কেবল ভারতবিরোধী বুলি দিয়েই হয়নি, বিরোধীদের অভিযোগে যদি কিছুটাও সত্যতা থাকে, তবে ইমরান অচিরেই ‘রিগিং খান’এর শিরোপাও পেতে পারেন। ইতিমধ্যেই অবশ্য তিনি তালিবান-সহ অন্য জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে মাখামাখির দৌলতে ‘তালিবান খান’এর তকমা পেয়েছেন!

ইমরানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ-এর এক সমর্থকের উল্লাস। ছবি: রয়টার্স

ইমরানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ-এর এক সমর্থকের উল্লাস। ছবি: রয়টার্স

শিবাজীপ্রতিম বসু
শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৮ ১১:৫৫
Share: Save:

শুরুটা তো ভালই হয়েছিল। ভারত-বিরোধী পাটা পিচ ছিল, খেলার (পড়ুন, ভোটের) আগে ও পরে আম্পায়ার (সামরিক বাহিনী) ও থার্ড আম্পায়ারের (আইএসআই/ জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির) চক্ষুলজ্জাহীন পক্ষপাতিত্ব ছিল। বিপক্ষের অধিনায়ক নওয়াজ শরিফ দেশে ফিরেই জেল-বন্দি অর্থাৎ মাঠের বাইরে, আর এক প্রতিদ্বন্দ্বী বিলাবল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রান বেশি পায়নি, অন্যান্য খুচরো দলগুলোর সংগ্রহে হাতে গোনা কিছু ‘রান’। তবু শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের জাতীয় ভোটের টুর্নামেন্টে ইমরান খানের ‘পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ’ (পিটিআই) যে ‘ডাকওয়ার্থ-লুইস’-এর জটিল পদ্ধতিতে অন্যান্য ছোট দলের সহায়তায় ক্ষমতার ট্রফি জেতার দাবি করতে হচ্ছে, তা কীসের ইঙ্গিত? পাক ক্রিকেট দলের প্রাক্তন কিংবদন্তী অধিনায়কের এই নতুন ইনিংসে তবে বিতর্কের কাদা লেগেই রইল!

তার সঙ্গেই দিনভর ছিল সন্ত্রাসী হিংসার কালো ছায়া। কোয়েটায় একটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে আত্মঘাতী জঙ্গি হানায় ৩১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। অন্যান্য বহু জায়গায় ভোটার পরিচয়ের কাগজপত্র দেখিয়েও বহু লোক টিভি ক্যামেরার সামনে ভোট দিতে না পারার অভিযোগ করছেন। ভোট গণনার গতিও অতি মন্থর। প্রধান দলগুলি, যারা পাল্টাপাল্টি করে পাকিস্তানের জাতীয় ক্ষমতায় দীর্ঘ দিন টিকেছিল— শরিফের পিএমএল-এন ও বেনজির ভুট্টোর পুত্র বিলাবল জারদারির পিপিপি নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে, তাদের দলের গণনার এজেন্টদের গণনা কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এবং এইসব বিশেষত সেই কেন্দ্রগুলিতে ঘটেছে যেখানে তারা (ইমরান খানের বিরোধীরা) বেশি শক্তিশালী।

অর্থাৎ, কেবল ভারতবিরোধী বুলি দিয়েই হয়নি, বিরোধীদের অভিযোগে যদি কিছুটাও সত্যতা থাকে, তবে ইমরান অচিরেই ‘রিগিং খান’এর শিরোপাও পেতে পারেন। ইতিমধ্যেই অবশ্য তিনি তালিবান-সহ অন্য জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে মাখামাখির দৌলতে ‘তালিবান খান’এর তকমা পেয়েছেন! এই জন্যই বোধহয় অতি দ্রুত আইএসআই ও সামরিক বাহিনীর কাছে ‘নীলচক্ষু বালক’ হয়ে উঠেছেন। গত নির্বাচনগুলিতে ইমরান তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা এই সব অভিযোগই পিএমএল-এন ও পিপিপি-র বিরুদ্ধে করে এসেছেন। এত কিছু সত্ত্বেও তবে এমন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ‘ভিক্ট্রি স্ট্যান্ড’-এর দিকে যাত্রা কেন? বিশেষজ্ঞরা এর মধ্যেও পাকিস্তানের অভ্যন্তরস্থ ‘গভীর রাষ্ট্রের’ (ডিপ স্টেট) ছায়া দেখতে পাচ্ছেন।

আরও পড়ুন: ইমরানে লাভই দেখছেন ভারতের গোয়েন্দারা

কিছু দিন আগে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শরিফ এক সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেছেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আছে আর একটি রাষ্ট্র, তারও ভিতরে আরও একটি রাষ্ট্র। ঠিক রূপকথার দৈত্যের প্রাণভোমরার মতো। এই ‘ডিপ স্টেট’ই পাকিস্তানের চালিকা শক্তি। পাকিস্তান রাষ্ট্রগঠনের কিছু দিন পরেই এই প্রাণভোমরার কেন্দ্রে ছিল সামরিক বাহিনী। ক্রমশ তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই এবং ১৯৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর ভারতবিরোধী নানা জঙ্গিগোষ্ঠী। এই ‘ডিপ স্টেট’ বরাবরই চেয়েছে পাকিস্তানের ‘নির্বাচিত’ সরকারগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং তাদের ‘ভারতবিরোধী’ অবস্থানে অটুট করে ধরে রাখতে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ যুদ্ধে (১৯৭১) ভারতের কাছে শোচনীয় পরাজয় ও প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান হাতছাড়া হওয়ায় কাশ্মীর ইস্যুর উন্মাদনা ও ভারতের সম্ভাব্য ‘আক্রমণের’ কল্পিত ভাষ্য বারবার প্রচারিত হতে হতে তা ভোটের আগে পাক জনতাকে কিছুটা উত্তেজিত করে রাখে আর অন্যদিকে সামরিক বাহিনী/ আইএসআই-এর যৌক্তিকতা প্রদান করে। এ বার কি তবে সেই ‘প্রাণভোমরা’ই ইমরানকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েও পুরোটা জিততে দিল না, যাতে জেতার পর সরকার গড়েও পিটিআই সরকার নানা নির্ণায়ক বিষয়ে তাদের ওপরেই নির্ভরশীল থাকে।

আরও পড়ুন: ‘ভোট দিন, হালুয়া-পুরি-কফি আপনার জন্য ফ্রি’

এই ‘ডিপ স্টেট’-এর পৃষ্ঠপোষকতাতেই মুম্বই হানার (২৬/৭) পিছনে প্রধান চক্রী জামাত-উদ-দাওয়া-র হাফিজ সইদ ও তাঁর পরিবারের নানা সদস্যকে নির্বাচনে লড়াইয়ের সুযোগ করে দিয়েছেন। এই গোষ্ঠী ছাড়াও আরও বেশ কিছু জঙ্গি গোষ্ঠী এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এই ভাবে সন্ত্রাসী ব্যক্তিদের জাতীয় রাজনীতির ‘মূল ধারায়’ ফিরিয়ে এনে কি রাষ্ট্রের এই মুখ্য নির্ণায়করা নাগরিকদের গণতান্ত্রিক পরিসরটাই আরও সঙ্কুচিত করে দিলেন না!

প্রশ্ন উঠেছে, এই নির্বাচনের প্রভাব ভারতের বিদেশনীতি ও সমরনীতিতে কতটা পড়বে? দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ইতিমধ্যেই তলানিতে। ইমরান প্রথম থেকেই (‘ডিপ স্টেট’-এর কৃপা পেতে) ভারত-বিরোধী অবস্থান নেওয়ায় গোড়ায় তা-ই টিকে থাকবে। কিন্তু আর একটা ব্যাপারও বুঝতে হবে। কিছু দিন আগেও পাকিস্তানের ভাগ্যনিয়ন্তা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এখন চিন। ভারত এখন আমেরিকার অনেক কাছাকাছি– প্রায় সহযোগী। কিন্তু আমেরিকার ভৌগোলিক অবস্থান তো সাত-সমুদ্র-তেরো-নদী-পার, আর চিন ঘরের দোরে। পাকিস্তানের মতো চিনের সঙ্গেও আমাদের সীমান্ত সংঘর্ষ ও বিবাদের ইতিহাস আছে। তাই, এই পট-পরিবর্তনের সময় ও তার পরে ভারতকে অনেক বেশি সাবধানে, স্থির-চিত্তে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Pakistan Election Imran Khan PTI
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE