খোঁজ পাওয়া গেল ব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে ‘বড়’ ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরের। যা দু’-দশ কোটি নয়, গ্রাস করতে পারে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি সূর্যকে।
বিজ্ঞানীরা জানান, আমাদের নক্ষত্রমণ্ডলের কেন্দ্রে যে কৃষ্ণগহ্বর রয়েছে, সেটি অন্তত ৪৩ লক্ষ সূর্যকে গিলে খেতে পারে। কিন্তু হদিস পাওয়া নতুন কৃষ্ণগহ্বরটি তার চেয়েও প্রায় আট হাজার গুণ বড়। এই কৃষ্ণগহ্বরের ভর সূর্যের ভরের চেয়ে প্রায় ৩,৬৩০ গুণ বেশি। অর্থাৎ, সহজ কথায় প্রায় ৩৬৩০ কোটি সূর্য এঁটে যেতে পারে এই কৃষ্ণগহ্বরে। যদিও এই ‘মহা রাক্ষস’ আমাদের নক্ষত্রমণ্ডল থেকে প্রায় ৫০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে এসডিএসএস জে১১৪৮+১৯৩০ নামক একটি নক্ষত্রমণ্ডলের কেন্দ্রে রয়েছে।
গত শতাব্দীর সাতের দশকের একেবারে গোড়ার দিকে প্রয়াত প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোলের চেহারা উত্তরোত্তর বাড়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা কিছুতেই কমে যেতে পারে না। এটাই হকিংয়ের ‘ব্ল্যাক হোলস’ এরিয়া থিয়োরেম’।
হকিং বুঝিয়েছিলেন, ব্ল্যাক হোল হল সেই খাবারের থালা, যার কানাটার নাম ‘ইভেন্ট হরাইজন’। সেই চৌহদ্দির মধ্যে একবার গিয়ে পড়লে আর রেহাই নেই। তখন কেবলই পতন! অত্যন্ত জোরালো অভিকর্ষ বলের টানে আশপাশের গ্যাসের মেঘ, নক্ষত্রদের গিলে খায় সে। বেরিয়ে আসতে পারে না এমনকি আলোও। স্থান-কালও দুমড়ে মিলিয়ে যায় সেখানে!
আরও পড়ুন:
যেহেতু গোগ্রাসে সে সব কিছু গিলে খায়, তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্ল্যাক হোল গায়েগতরেও বাড়তে থাকে। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, নয়া আবিষ্কৃত ব্ল্যাক হোলটির আকার যে ভাবে বেড়েছে, তাতে মনে করা হচ্ছে, ব্রহ্মাণ্ডের জন্মের পর পরেই সেটির সৃষ্টি হয়েছে। বিজ্ঞানীদের যুক্তি, এই ব্রহ্মাণ্ডের বয়স মেরেকেটে ১,৩৮০ কোটি বছর। সেই সময় যদি কোনও মহা রাক্ষসের জন্ম হয়ে থাকে, আড়েবহরে বাড়তে বাড়তে এত দিনে সেটির অন্তত পাঁচ হাজার কোটি সূর্যকে গিলে খাওয়ার ক্ষমতা তৈরি হওয়ার কথা। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এই ব্ল্যাক হোলের ভর সূর্যের ভরের চেয়ে সাড়ে তিন হাজার গুণেরও বেশি। অর্থাৎ খুবই কাছাকাছি।
কিন্তু কী ভাবে এই ব্ল্যাক হোলের হদিস মিলল? বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, ব্ল্যাক হোল জিনিসটার আলাদা করে ছবি তোলা যায় না। রেডিয়ো টেলিস্কোপের কাজ মানুষের চোখে অদৃশ্য বেতার তরঙ্গ শনাক্ত করা। আর ব্ল্যাক হোলের খিদে এমন আগ্রাসী যে, তা সব কিছু গিলে খায়। রেহাই দেয় না কোনও রকমের তরঙ্গকেও। সে জন্যই তার নামে ‘ব্ল্যাক’। বাংলায় ‘অন্ধকূপ’।
ব্ল্যাক হোলের চৌহদ্দির দিকে ধাবমান যে কোনও বস্তুপিণ্ডই ভীমবেগে ঘুরতে থাকে। ধাবমান সেই বস্তু থেকে নানা রকমের ছটা বেরোয়। সেই আলোর ছটাই বিশ্লেষণ করেন বিজ্ঞানীরা। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং’। ছায়াপথের যেখানে কৃষ্ণগহ্বর রয়েছে, সেখানে আলো কতটা বেঁকে যাচ্ছে, তা-ই খুঁটিয়ে দেখা হয়।
বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, আলো সরলরেখায় চলে। কিন্তু আলোর পথে এমন ভারী কোনও বস্তু এবং তার অভিকর্ষ বলের টানে সেই আলো বেঁকে যেতে পারে। যদি বাঁক বেশি হয়, তা হলে ধরে নিতে হবে, সেই নক্ষত্রমণ্ডলের মাঝে নিশ্চয়ই বড় কিছু রয়েছে। আর নক্ষত্রমণ্ডলের কেন্দ্রে সাধারণত ব্ল্যাক হোলই থাকে। এই ধারণাকে কাজে লাগিয়েই হাজারো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন, এ পর্যন্ত তাঁদের জানা সর্ববৃহৎ কৃষ্ণগহ্বর এটিই। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, আলো যে ভাবে বাঁক নিয়েছে, তাতে তার চেহারা অনেকটা ঘোড়ার খুরের মতো।
আরও পড়ুন:
অনুমান, এককালে এই নক্ষত্রমণ্ডলটিও সাধারণ নক্ষত্রমণ্ডলের মতোই ছিল। তার কেন্দ্রেও একাধিক ব্ল্যাক হোল ছিল। কিন্তু সেই ব্ল্যাক হোলগুলিও পরে একে অপরের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে। তার ফলে এই ব্ল্যাক হোলটি আড়বহড়ে এতটা বেড়েছে। এই কারণে এই নক্ষত্রমণ্ডলটিকে ‘জীবাশ্ম নক্ষত্রমণ্ডল’ বলছেন বিজ্ঞানীরা।
এর আগে ‘টন-৬১৮’ নামেও একটি ব্ল্যাক হোলের হদিস মিলেছিল। প্রাথমিক ভাবে বিজ্ঞানীদের ধারণা হয়েছিল, সেটি সূর্যের ভরের প্রায় সাড়ে ছ’হাজার গুণ বেশি। পরে দেখা যায়, অতটাও নয়। মেরেকেটে চার হাজার কোটি হবে! যদিও এই হিসাব নিখুঁত নয় বলেই বিজ্ঞানীদের একাংশের ধারণা। কিন্তু নয়া আবিষ্কৃত ব্ল্যাক হোলের চেহারার যে পরিমাপ করা হয়েছে, তা প্রায় সঠিক বলেই মনে করছেন তাঁরা।