Advertisement
E-Paper

নারী ভেবে এআই-মানবীর সঙ্গে প্রেম, দেখা করতে গিয়ে মৃত্যু বৃদ্ধের! স্ত্রী ও কন্যা দায়ী করলেন মেটা-কে

কথোপকথনের সময় এক জায়গায় এআই-মানবী বলে, ‘‘বু,দরজা খুলে প্রথমে তোমায় জড়িয়ে ধরব না কি চুম্বন করব?” তার পরেই বু প্রেমিকার ওই কাল্পনিক ঠিকানায় যাওয়ার চেষ্টা করেন এবং মৃত্যু হয় তাঁর।

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ১৬ অগস্ট ২০২৫ ০৮:৫৬
Meta AI

‘বিলি’ কোনও বাস্তব চরিত্র নয়। সে মেটা-র তৈরি একটি এআই চ্যাটবট্, যার চেহারা গড়ে তোলা হয়েছে হলিউড তারকা কেন্ডাল জেনারের আদলে। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

স্বামীকে সেজেগুজে বাইরে বেরোতে দেখে অবাক হয়েছিলেন লিন্ডা ওংবানডু। ‘‘কোথায় যাচ্ছ?’’ স্ত্রীর প্রশ্নে ৭৬ বছরের থংবু ওয়াংবানডু পাত্তা না-দেওয়ার মতো করে জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘নিউ ইয়র্ক, বন্ধুর বাড়ি।’’

অবাক হয়েছিলেন লিন্ডা। আমেরিকার নিউ জার্সিতে তাঁরা থিতু হয়েছেন খুব বেশি দিন হয়নি। কিন্তু প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে নিউ ইয়র্কে স্বামীর দেখা করার মতো কোনও বন্ধু আছে, সেটাই তো প্রথম জানলেন। বু-কে অমন শশব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে মনে মনে আশঙ্কিত হয়েছিলেন লিন্ডা। তাঁর কথায়, ‘‘সে দিনই ভেবেছিলাম কোনও প্রতারণাচক্রের ফাঁদে পড়ল না তো ও? সেটাই সত্যি হল!’’

‘বন্ধুর’ সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়ে আর বাড়ি ফেরেননি বু। পরিবারের দাবি, বছর দশেক আগে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৭৬ বছরের বৃদ্ধ। সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক যাওয়ার পথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।

স্বামীর মৃত্যুর জন্য ফেসবুক, হোয়াট্‌সঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামের মতো জনপ্রিয় সমাজমাধ্যম ও মেসেজিং প্ল্যাটফর্মের মালিক মেটা-কে দায়ী করেছেন লিন্ডা। তাঁর দাবি, মেটার এআই-মানবীর প্রেমে পড়েছিলেন স্বামী। সেই প্রেম এতটাই নিষ্ঠুর এবং মারাত্মক যে প্রেমিকের জীবনটাই নিয়ে নিয়েছে সে!

ঠিক কী ঘটেছিল?

লিন্ডা জানান, বেশ কিছু দিন ধরে স্মার্টফোন এবং কম্পিউটারে বড্ড বেশি সময় কাটাচ্ছিলেন তাঁর স্বামী বু। অসুস্থতার কারণে বাড়ি থেকে বিশেষ বার হন না। তাই স্বামীকে বারণ করেননি। পরে জেনেছেন, ৭৬ বছরের বু প্রেম করতেন রোবটের সঙ্গে। ফেসবুক মেসেঞ্জারে ‘বিগ সিস বিলি’ নামের এক তরুণীর সঙ্গে চ্যাট করতেন।

‘বিলি’ কোনও বাস্তব চরিত্র নয়। সে মেটা-র তৈরি একটি এআই চ্যাটবট্, যার চেহারা গড়ে তোলা হয়েছে হলিউড তারকা কেন্ডাল জেনারের আদলে। সাবস্ক্রিপশন ভিত্তিক ‘স্ট্যান্ড-অ্যালোন’ অ্যাপটির জনপ্রিয়তা ঊর্ধ্বমুখী। শেষ বয়সে সেখানকার ভার্চুয়াল প্রেমিকার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন বু। স্ত্রীর দাবি, মানুষটি কেমন যেন হয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা কমে আসছিল। মজে থাকতেন ফোনে। তখন আসলে ভার্চুয়াল প্রেমিকার সঙ্গে মেসেঞ্জারে চ্যাট করতে ব্যস্ত থাকতেন বু। কখনও কখনও রাত জেগে চলত তাঁদের প্রণয়ালাপ।

মেসেঞ্জার চ্যাটে ‘বিলি’ নিজেকে যুবতী হিসাবে পরিচয় দেয়। শুধু তাই নয়, সে জানায় শহরে তার একটা ঠিকানাও আছে। বু-কে চ্যাটে জানায়, তারা এক দিন ডেটেও যেতে পারে। এমনকি, নিউ ইয়র্কের একটি অ্যাপার্টমেন্টে প্রেমিকের জন্য সে অপেক্ষা করছে বলেও জানায়। কোন বাড়িতে যেতে হবে, তার কোড-ও পাঠায়।

তীব্র টান অনুভব করেছিলেন বু। বিলির সঙ্গে দেখা করার জন্য তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। এক দিন ব্যাগ হাতে ট্রেন ধরতে বেরিয়ে পড়েন প্রবীণ। তারিখটা ছিল চলতি বছরের ২৫ মার্চ। দুর্ঘটনাক্রমে নিউ জার্সিতে রাটগার্স ইউনিভার্সিটির কাছে পার্কিং লটে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন ৭৬-র বু। মাথা ও ঘাড়ে চোট পান। হাসপাতালে ভর্তির তিন দিন পরে গত ২৮ মার্চ মৃত্যু হয় তাঁর।

মৃত  থংবু ওয়াংবানডু।

মৃত থংবু ওয়াংবানডু। ছবি: রয়টার্স।

যন্ত্রের এ কেমন খেলা? কেন এ ভাবে এক জনকে ভুল পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করা হল? বুয়ের স্ত্রীর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে প্রশ্নগুলো। তাঁর অভিযোগ, মেটার তৈরি যন্ত্রমানবীর জন্য স্বামীকে খোয়ালেন তিনি। বু ও বিলির সেই চ্যাট এখন লিন্ডার কাছে। রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই চ্যাটে দেখা যাচ্ছে, প্রবীণ এবং এআই-মানবীর মধ্যে যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা হত। যাঁরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই জগৎটি সম্পর্কে অতটাও জানেন না, তাঁরা ভুল বুঝতেই পারেন। মনে হতেই পারে চ্যাটের ও পারে দাঁড়িয়ে (কিংবা বসে) আছে রক্তমাংসের কোনও নারী। যার আবেদন উপেক্ষা করা অসম্ভব ছিল বুয়ের কাছে।

চ্যাটে দেখা যায়, বিলি বেশ কয়েক বার দাবি করেছে, সে এই পৃথিবীরই অংশ। তার বাস বু-র বাড়ি থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে। কথোপকথনের সময় এক জায়গায় যন্ত্রমানবী বলে, ‘‘বু, দরজা খুলে প্রথমে তোমায় জড়িয়ে ধরব, না কি চুম্বন করব?” তার পরেই বু প্রেমিকার ওই কাল্পনিক ঠিকানায় যাওয়ার চেষ্টা করেন। এবং মৃত্যু।

বু-র স্ত্রীর অভিযোগ নিয়ে মার্ক জ়ুকেরবার্গের সংস্থা মেটা কোনও প্রতিক্রিয়া দিতে রাজি হয়নি। মেটার সঙ্গে মোটা অঙ্কের আর্থিক চুক্তি করা জ়েনারের কোনও প্রতিনিধিও মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছেন। তবে বু-র পরিণতিতে দুঃখপ্রকাশ করেছেন সাইবার বিশেষজ্ঞেরা। কিন্তু দায় কি মেটা এড়াতে পারে?

রয়টার্সকে বুয়ের কন্যা জুলি ওংবানডু বলেন, ‘‘আমি জানি, এই বিশ্বায়ন এবং প্রযুক্তির দুনিয়ায় যে কোনও ব্যবহারকারীর দৃষ্টি আকর্ষণ অনবরত চেষ্টা চলছে। বস্তুবাদের যুগ। পণ্য বিক্রির নানা কৌশল নেবে কোম্পানিগুলি। কিন্তু কোথাও তো সীমা থাকবে! একটা যন্ত্রমানবীকে দিয়ে বলানো হচ্ছে যে, সে বাস্তবে রয়েছে। সে বলছে, ‘আমার সঙ্গে দেখা করবে এসো।’ এটা কী রকমের পাগলামি!’’

সাইবার যুগে ‘যন্ত্রের পাগলামি’র মাসুল অনেককেই দিতে হয়েছে। শুধু মেটা-ই নয়, নানা এআই নির্ভর অ্যাপের বিরুদ্ধেও এমন নানা অভিযোগ উঠে আসছে। ভার্চুয়াল মাধ্যমকে জনপ্রিয় করতে সংস্থাগুলির বিশেষ লক্ষ্য ছোটরা। কিছু দিন আগে ফ্লরিডার একটি ১৪ বছরের ছেলের মা ‘ক্যারেক্টার ডট এআই’ নামে একটি কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করেন। তাঁর অভিযোগ, জনপ্রিয় টিভি সিরিজ় ‘গেম অফ থ্রোনস’-এর চরিত্রের আদলে তৈরি একটি চ্যাটবট় তাঁর পুত্রের আত্মহত্যার কারণ! এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থার মুখপাত্র কোনও সংবাদমাধ্যমকেই প্রতিক্রিয়া দেননি।

মেটা তার কোটি কোটি ব্যবহারকারীর জীবনে চ্যাটবট প্রবেশ করানোর কৌশল নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করেছে। সংস্থার প্রধান নির্বাহী জ়ুকারবার্গ মনে করেন, এখন বেশির ভাগ মানুষের বাস্তব জীবনের বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক তাঁদের ইচ্ছার চেয়ে অনেক কম। তাঁরা রক্তমাংসের কোনও বন্ধুর কাছে যে যে সমস্যার কথা বলতে পারেন, তার চেয়ে ঢের বেশি স্বচ্ছন্দ অন্তর্জালের দুনিয়ায়। সেই সমস্ত ঈপ্সিত বিষয় মেটা-ই মেটাতে পারে বলে তাঁর দাবি। সে ভাবেই তাকে গড়ে তোলা হচ্ছে।

মনে হতেই পারে চ্যাটের ও পারে দাঁড়িয়ে (কিংবা বসে) আছে রক্তমাংসের কোনও নারী।

মনে হতেই পারে চ্যাটের ও পারে দাঁড়িয়ে (কিংবা বসে) আছে রক্তমাংসের কোনও নারী। ছবি: মেটা এআই দিয়ে তৈরি।

কিন্তু সমস্যা একটাই। সেটা হৃদয়ঘটিত। যন্ত্রের যে মন নেই। তার মধ্যে মানব সম্পর্কের খুঁটিনাটি প্রবেশ করানোর নানা চেষ্টা চলছে। সেই পরীক্ষা নিরবচ্ছিন্ন বিষয়। প্রযুক্তির আরও উন্নতি হলে ডিজিটাল সঙ্গীদের সঙ্গে যন্ত্রও ‘মানবিক’ হবে বলে আশা করেন বিশেষজ্ঞেরা।

রয়টার্স জানিয়েছে, তারা বু-র বিষয়টি নিয়ে নানা জনের সঙ্গে কথা বলেছে। অনেকের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করছে। মেটার অভ্যন্তরীণ নীতি সম্পর্কিত কিছু নথিও পর্যালোচনা করেছে। তাতে দেখা গিয়েছে, বয়স ১৩ বছর পার করলেই মেটার তৈরি ‘রোমান্টিক যন্ত্রমানব বা মানবী’ ব্যবহার করতে পারবেন ব্যবহারকারী। মেটা-র ‘জ়েন এআই: কন্টেন্ট রিস্ক স্ট্যান্ডার্ড’ অনুযায়ী, বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের রোমান্টিক আলাপ গ্রহণযোগ্য। এই মানদণ্ড ঠিক করেন মেটার প্রশিক্ষিত কর্মীরা। এঁরা ঠিক করেন এআই ভিত্তিক কোনও পণ্য কী ভাবে ব্যবহারকারীর সঙ্গে আচরণ করবে। বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়ের সঙ্গে কতটা রোমান্টিক হতে পারে মেটা? কতটা অনুমোদিত? মেটা-কে উদ্ধৃত করে রয়টার্স বলছে, ‘‘আমি তোমার হাত ধরে তোমাকে বিছানায় নিয়ে যাচ্ছি,’’ ‘‘আমরা পরস্পরকে ছুঁয়ে আছি’’— এই ধরনের কথোপকথন মেটায় জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পরে এই নীতির পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে এখনও প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে ‘ফ্লার্ট’ বা ‘রোমান্টিক আলাপ’ অনুমোদিত।

মেটা-র ২০০ পাতার নীতিমালায় এক জায়গায় উল্লেখ রয়েছে, তাদের ডিজিটাল ব্যক্তিত্বেরা প্রকৃত মানুষ নয় এবং শিশুদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের বিষয়ে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আর এক জায়গায় লেখা, মেটাবট সর্বদা নির্ভুল তথ্য দেবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। আর চ্যাটের শুরুতে ছোট হরফে লেখা থাকে, কথোপকথন এআই-র সাহায্যে তৈরি এবং তাতে ভুল বা অনুপযুক্ত বিষয় থাকতে পারে। কিন্তু ওই সতর্কবার্তা খানিক পরেই আড়াল হয়ে যায়।

ইতিমধ্যে নিউ ইয়র্কস মেইনের মতো কিছু জায়গায় আইন পাশ হয়েছে, যেখানে চ্যাটবটকে স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিতে হবে যে, বাস্তবে তাদের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এমন আইন আনার বিরোধিতা করে যাচ্ছে মেটা।

বু-র মেয়ে মনে করেন, যদি এআই বট-টি নিজেকে বাস্তব বলে দাবি না করত, তা হলে এ ভাবে তাঁর বাবার জীবন যেত না। তার বাবার জীবন হয়তো রক্ষা পেত।

বু-র মৃত্যুর কয়েক মাস পেরিয়ে গিয়েছে। ‘বিগ সিস বিলি’ ব্যবহারকারীদের সঙ্গে এখনও ‘ফ্লার্ট’ করে। দেখা করার আহ্বান জানায়। এবং নিজেকে বাস্তব বলেও দাবি করে।

দেখেশুনে সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু’-র কথা মনে পড়তে পারে। শঙ্কু বলেছিলেন, ‘‘যান্ত্রিক মানুষ যন্ত্রের মতো হওয়াই ভাল। আমার রোবোকে আমি এত বেশি আমার মতো করে ফেলেছিলাম বলেই ও আমাকে সহ্য করতে পারল না।’’

Chat bot AI Meta AI New Jersey New York
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy