বয়স বাড়ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বুড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। অকালে কারও চুল পাকছে, কারও পড়ে যাচ্ছে দাঁত। কিন্তু আপনার মস্তিষ্কের (ব্রেন) ‘বয়স’ কত? তার খোঁজ কি নিয়েছেন কখনও? নতুন গবেষণা বলছে, মস্তিষ্কের ‘বয়স’ই বলে দিতে পারে আপনার আয়ু। বেঁচে থাকার সঙ্গে চনমনে, তাজা মস্তিষ্কের সম্পর্ক অনেক বেশি।
আমাদের শরীরের এক একটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বুড়িয়ে যেতে এক এক রকম সময় নেয়। কোনও অঙ্গ হয়তো কমবয়সেই বুড়িয়ে যায়। আবার কোনও অঙ্গ বেশি বয়সেও থেকে যায় তাজা। গবেষকেরা সম্প্রতি শরীরের এমন ১১টি অঙ্গের উপর পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখেছেন। জানিয়েছেন, মস্তিষ্কই আয়ু নির্ধারণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযোগী।
ক্যালিফর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক ব্রিটেনের স্বাস্থ্য গবেষণা ডেটাবেস থেকে মোট ৪৪,৪৯৮ জনের তথ্য নিয়ে তার উপর পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখেছেন। ৪০ থেকে ৭০ বছর বয়সি ওই ৪৪,৪৯৮ জনের তথ্যে রক্ত বিশ্লেষণ পদ্ধতি (ব্লাড অ্যানালিসিস টেকনিক) প্রয়োগ করা হয়েছে। এর থেকে তাঁরা পেয়েছেন ওই মানুষগুলির মোট ১১টি অঙ্গের আনুমানিক বয়স। এর মধ্যে মস্তিষ্ক ছাড়াও ছিল হার্ট, ফুসফুস, পেশি, কিডনি, লিভার, অন্ত্র, অগ্ন্যাশয়, চর্বি, শিরা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।
আরও পড়ুন:
এই অঙ্গের ‘বয়স’ ব্যক্তিবিশেষের স্বাস্থ্যের দীর্ঘ ১৭ বছরের পরিসংখ্যানের (রেকর্ড) সঙ্গে তুলনা করে দেখা হয়েছে। সাধারণ ভাবে দেখা গিয়েছে, অঙ্গের চনমনে ভাব যত কম, মৃত্যুর ঝুঁকিও তত বেশি। এদের মধ্যে থেকে মস্তিষ্ককেই আদর্শ প্রতিনিধি হিসাবে বেছে নেওয়া যেতে পারে, জানিয়েছেন গবেষকেরা। পরিসংখ্যান বলছে, যাঁদের ব্রেন যত কম বুড়িয়েছে, তাঁদের আয়ু তত দীর্ঘ হয়েছে। স্ট্যানফর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসায়েন্টিস্ট টনি উইস্-কোরে বলেছেন, ‘‘ব্রেনই হল আমাদের দীর্ঘ জীবনের দ্বাররক্ষী। যদি আপনার ব্রেন বুড়িয়ে যায়, মৃত্যুর সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে। আর আপনার বয়স যতই বাড়ুক, ব্রেন সতেজ থাকলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়।’’
যে রক্তপরীক্ষার পদ্ধতি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে, তা মূলত প্রোটিনের মাত্রা পরিমাপ করে। সেই প্রোটিন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়। জটিল কিছু গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বার করেছেন, কোন অঙ্গ কেমন চলছে। কোন অঙ্গ কতটা সতেজ। যে অঙ্গ যত ‘বয়স্ক’, তার প্রোটিন তত বেশি ক্ষয়ক্ষতি নির্দেশ করেছে। সেই অঙ্গে রোগ ধরার সম্ভাবনাও তাই তত বেশি। একই ভাবে এমন ‘বয়স্ক’ অঙ্গের সংখ্যা যার শরীরে যত বেশি রয়েছে, তার রোগভোগের সম্ভাবনাও তত বেড়ে যায়।
আরও পড়ুন:
গবেষণা বলছে, যাঁদের ব্রেন ‘অত্যন্ত বয়স্ক’ (বৃদ্ধ বয়সের সাত শতাংশ), তাঁদের ক্ষেত্রে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রায় দ্বিগুণ। তুলনায় যাঁদের ব্রেনের বয়স কম, তাঁদের ব্রেন সাধারণ জৈবিক বয়সের সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ণ। ‘অত্যন্ত চনমনে’ মস্তিষ্কের অধিকারী যাঁরা, তাঁদের অকালমৃত্যুর (শারীরিক কারণে) সম্ভাবনা ৪০ শতাংশ কমে যায়।
বিজ্ঞান, প্রযুক্তির উন্নয়নে মানুষের গড় আয়ু যত বাড়ছে, ততই চারপাশে বাড়ছে এমন মানুষের সংখ্যা, যাঁদের স্মৃতি দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। তাঁরা অ্যালঝাইমার্সে আক্রান্ত হচ্ছেন। যে রোগ নিরাময়ের কোনও ওষুধ এখনও নেই। গবেষকদের দাবি, ‘বয়স্ক’ ব্রেনের মানুষদের অ্যালঝাইমার্সে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ৩.১ গুণ বেড়ে যায়। যাঁদের ব্রেন চনমনে, তাঁদের এই রোগের সম্ভাবনা থাকে ৭৪ শতাংশ কম।
গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
কী ভাবে ব্রেনকে সতেজ রাখবেন?
- কত সাবধানে আপনি রাস্তা পার হচ্ছেন, কত পুষ্টিকর খাবার খাচ্ছেন— প্রতি দিনের এমনই নানা ছোটখাটো বিষয়ের উপর মস্তিষ্কের ‘বয়স’ নির্ভর করে।
- মস্তিষ্ককে সতেজ রাখতে হলে এমন কাজ করতে হবে, যা মন ভাল রাখে। যা উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়। এতে মস্তিষ্কে নতুন কোষও গড়ে উঠতে পারে।
- পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার উপরে অনেকাংশে নির্ভর করে ব্রেনের ‘স্বাস্থ্য’। যাঁরা ফল, সব্জি, মাছ, বাদাম জাতীয় প্রোটিনযুক্ত খাবার খান, তাঁদের স্মৃতিশক্তি সতেজ থাকে।
- মস্তিষ্কের খাতিরে পেশিকেও সবল রাখা জরুরি। নিয়মিত ব্যায়াম করলে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে রক্ত সরবরাহ বেশি হয়। যেখান থেকে মানুষ চিন্তা করে, সেখানেও অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত দ্রুত পৌঁছে যায় ব্যায়ামের ফলে।
- উচ্চ রক্তচাপ মস্তিষ্ককে দুর্বল করে তুলতে পারে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাই প্রয়োজন ব্যায়াম, মানসিক চাপমুক্ততা এবং ভাল খাবার। দিনে দু’পেগের বেশি মদ খাওয়া উচিত নয়।
- রক্তে শর্করার মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখতে। ডায়াবেটিস থাকলে স্মৃতিভ্রংশতার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
- কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা, কম ডোজ়ের অ্যাসপিরিন নেওয়া মস্তিষ্কের বুড়িয়ে যাওয়া রুখে দিতে সক্ষম। সেই সঙ্গে যে কোনও প্রকার তামাকজাত দ্রব্য অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে।
- সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধি মস্তিষ্ককে সতেজ রাখার অন্যতম চাবিকাঠি। গবেষণা বলছে, যাঁরা একা একা থাকেন, একা একাই চিন্তা করেন, তাঁদের মস্তিষ্কের ‘বয়স’ হয়ে যায় তাড়াতাড়ি। কিন্তু যাঁরা সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকেন, নিজের চিন্তা অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেন, তাঁদের মস্তিষ্ক বেশি দিন চনমনে থাকে।