Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Indian eyed turtle

পূর্ব মেদিনীপুরের পুকুরে তরাইয়ের কচ্ছপের বসত

ইংরেজি নাম, ‘ইন্ডিয়ান আইড টার্টল’। আইইউসিএন-এর ‘লাল তালিকায়’ সঙ্কটাপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত এই মিষ্টি জলের কচ্ছপগুলির পিঠের শক্ত খোলের উপর চোখের মতো গোল দাগ থাকে।

ইন্ডিয়ান আইড টার্টল। ছবি: অর্ধেন্দু দাস মহাপাত্র

ইন্ডিয়ান আইড টার্টল। ছবি: অর্ধেন্দু দাস মহাপাত্র

সায়ন ত্রিপাঠী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০২০ ১৫:০০
Share: Save:

জুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার (জেডএসআই) তথ্য বলছে, ব্রিটিশ জমানায় যশোর-খুলনা-সাতক্ষীরায় তাদের দেখা যেত। কিন্তু দেশভাগের পরে দক্ষিণবঙ্গে তাদের উপস্থিতি নথিভুক্ত হয়নি। কিছুদিন আগে পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা মহকুমায় সেই কচ্ছপ প্রজাতিটিকে খুঁজে পেয়েছেন রাজ্যেরই চার বন্যপ্রাণ সমীক্ষক। ব্রিটিশ হার্পেটলজিক্যাল সোসাইটির জার্নাল ‘দ্য হার্পেটলজিক্যাল বুলেটিন’-এ সম্প্রতি বিষয়ে তাঁদের লেখা গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে।

ইংরেজি নাম, ‘ইন্ডিয়ান আইড টার্টল’। বিজ্ঞানের পরিভাষায়, 'মোরেনিয়া পেটারসি'। আইইউসিএন-এর ‘লাল তালিকায়’ (রেড ডেটা লিস্ট) ‘সঙ্কটাপন্ন’ (ভালনারেবল) প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত এই মিষ্টি জলের কচ্ছপগুলির পিঠের শক্ত খোলের উপর ছোট চোখের মতো গোল দাগ থাকে। আর সে কারণেই ইংরেজিতে এমন নাম। বছর দেড়েক আগে এগরা সারদা শশীভূষণ কলেজের প্রাণীবিদ্যার বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক সুদীপ্তকুমার ঘড়াই এবং কলেজের স্নাতকোত্তর স্তরের ছাত্র তথা কোস্টাল ইকোলজি রিসার্চ ল্যাবরেটরির গবেষক অর্ধেন্দু দাস মহাপাত্র এলাকার পাঁচরোল গ্রামের একটি পুকুরে একটি আইড টার্টল খুঁজে পান। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন হুগলির বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ সংস্থা শিমুলতলা কনজারভেশনিস্টের দুই তরুণ সমীক্ষক অন্বেষণ পাত্র ও বিশাল সাঁতরা।

অন্বেষণের কথায়, ‘‘আমরা অনেক দিন ধরেই দক্ষিণবঙ্গে বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপের আবাসস্থলগুলি চিহ্নিত করার কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গে আগে কখনও আইড টার্টল দেখা গিয়েছে বলে শুনিনি। প্রথমে তাই আমরা ভেবেছিলাম, কারও পোষা কচ্ছপ পালিয়ে এসে ওই পুকুরে আশ্রয় নিয়েছে অথবা কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে ছেড়ে দিয়ে গিয়েছে।’’

পরবর্তী কয়েক মাস ধরে আশপাশের পুকুর, জলা, খাল, বিলে লাগাতার অনুসন্ধান চালিয়ে ‘চোখওয়ালা কচ্ছপে’-র একাধিক বসতি চিহ্নিত করেন অন্বেষণরা। তাঁদের থেকে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন জুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সরীসৃপ বিজ্ঞানী কৌশিক দেউটি এবং তাঁর সহকারীরা। তিনি বলেন, ‘‘এগরা শহরের আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের জলাভূমি ও পুকুরে ইন্ডিয়ান আইড টার্টলের প্রজননক্ষেত্র রয়েছে।’’

কৌশিক জানিয়েছেন, উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারের তরাই-ভাবর অঞ্চলে নিয়মিত এদের দেখা মেলে। জেডএসআই-এর নথি বলছে, অসম-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্য এবং বাংলাদেশে এদের উপস্থিতি একাধিক বার নথিভুক্ত হয়েছে। অতীতে উত্তরবঙ্গেও এদের সন্ধান মিলেছে। তাঁর কথায়, ‘‘ইংরেজ আমলে জন অ্যান্ডারসন নামে এক গবেষক যশোর থেকেই এই কচ্ছপের নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন। সেটি এখনও ব্রিটিশ মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি-তে সংরক্ষিত রয়েছ

পাঁচরোলের এই পুকুরেই প্রথম মিলেছিল ‘চোখওয়ালা কচ্ছপ’। ছবি: অন্বেষণ পাত্র

গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিকা অঞ্চলে এই কচ্ছপের অস্তিত্ব থাকলেও বাসস্থান ধ্বংস, পরিবেশ দূষণ ও চোরা শিকারের ফলে তাদের সংখ্যা কমছে। এই পরিস্থিতিতে পূর্ব মেদিনীপুরে নতুন বসতের সন্ধান মেলায় উৎসাহী প্রাণীবিজ্ঞানীরা। কৌশিকের কথায়, ‘‘দক্ষিণবঙ্গের আর কোনও স্থানে এরা টিকে রয়েছে রয়েছে কি না, তা জানার জন্য নিবিড় সমীক্ষার প্রয়োজন।’’ তিনি জানান, এগরার ওই এলাকায় ইন্ডিয়ান আইড টার্টলের পাশাপাশি নরম খোলার ইন্ডিয়ান ফ্ল্যাপশেল টার্টলের (লাইসেমিজ পাঙ্কটাটা) বসতি রয়েছে। কিন্তু স্থানীয় গ্রামবাসীদের একাংশ আইন ভেঙে ফ্ল্যাপশেল টার্টলের মাংস খেলেও ধর্মীয় সংস্কারের কারণে ‘চোখওয়ালা কচ্ছপ’ মারে না। ফলে ‘ফাঁড়া’ অনেকটা কম।

পরিবেশের বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় কচ্ছপের ভূমিকা অপরিসীম। মিষ্টি জলের কচ্ছপদের অধিকাংশই ‘সর্বভুক’। ফলে তারা জলজ পোকামাকড়ের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে। অন্য দিকে তেমনি সমস্ত রকমের জৈব আবর্জনা ও মৃত প্রাণীর দেহাবশেষ খেয়ে জলকে দূষণ থেকে রক্ষা করে। কচ্ছপ সংরক্ষণের কাজে জড়িত আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘টার্টল সারভাইভ্যাল অ্যালায়েন্স’-এর সদস্য রাজা মণ্ডল জানিয়েছেন, ইন্ডিয়ান আইড টার্টলরা মূলত জলজ উদ্ভিদে পূর্ণ অগভীর পুকুর-ডোবা-ঝিল-খাল পছন্দ করে। অনুকূল পরিবেশ পেলে ভাল ভাবেই বংশবৃদ্ধি করতে পারে তারা।

আরও পড়ুন: ২৪ ঘণ্টায় ৭৬৪৭২ নতুন আক্রান্ত, সংক্রমণ হার আটকে আট শতাংশে

কিন্তু পূর্ব মেদিনীপুরের ওই বিশেষ অঞ্চলকেই কেন তারা বেছে নিল? কৌশিকের ব্যাখ্যা, ‘‘হতেই পারে, অতীতে গঙ্গা এবং তার সংযোগরক্ষাকারী নদীগুলির অববাহিকার অনেক এলাকাতেই তারা বসত করেছিল। তার পর বাসস্থান ধ্বংস হওয়ায় সেই সব এলাকা থেকে লুপ্ত হয়ে বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী হিসেবে এগরার ওই গ্রামগুলিতে টিকে রয়েছে।’’ রাজার মতে, ‘‘সাধারণ ভাবে পূর্ব মেদিনীপুরের ওই এলাকায় এদের দেখা পাওয়ার কথা নয়। হয়তো অতীতে কেউ কয়েকটি কচ্ছপ পুষতে এনেছিলেন। মুক্তি পেয়ে অনুকুল পরিবেশে ওরা বংশবৃদ্ধি করছে।’’

আরও পড়ুন: ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই নিতে হবে ফাইনাল পরীক্ষা, নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE