Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Jammu And Kashmir

বছরের পর বছর পেট ভরায় কাশ্মীর, এই প্রথম লাশ পাঠাল বাহালনগরে

এত বছরে সেই দূর দেশ থেকে এমন ভাবে লাশ হয়ে ফিরে আসেননি কেউ। মঙ্গলবারের ঘটনা তাই প্রায় অভাবনীয়ই ছিল।

খবরে নজর গ্রামবাসীদের। ছবি: পিটিআই।

খবরে নজর গ্রামবাসীদের। ছবি: পিটিআই।

সিজার মণ্ডল
বাহালনগর (সাগরদিঘি, মুর্শিদাবাদ) শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৯ ২০:২১
Share: Save:

মেরেকেটে তিনশো মিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে গোটা একটা পাড়া। বাহালনগর দক্ষিণ পাড়া। সেই পাড়ারই পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে জঙ্গিদের গুলিতে। দু’দশকের বেশি সময় ধরে এই গ্রামের মানুষ জীবিকার টানে পাড়ি জমান কাশ্মীরে। এই দু’দশকে উপত্যকার রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। জঙ্গি হামলা হয়েছে। সেনা অভিযান হয়েছে। অনেক কিছু বদলেছে। কিন্তু বদলায়নি বাহালনগর। ফি বছর পরিযায়ী পাখির মতোই এই গ্রাম থেকে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে উপত্যকার অনামী গ্রামে ডেরা বাঁধেন তাঁরা।

কিন্তু এত বছরে সেই দূর দেশ থেকে এমন ভাবে লাশ হয়ে ফিরে আসেননি কেউ। মঙ্গলবারের ঘটনা তাই প্রায় অভাবনীয়ই ছিল। গোটা গ্রাম জুড়ে এখন বিস্ময় আর শোকের আবহ। কিন্তু গ্রামে কয়েক ঘণ্টা কাটালেই টের পাওয়া যায়, শোক তো আছে, কিন্তু তার মধ্যেও বহু পরিবারকে কেমন যেন অসহায় করে রেখেছে স্রেফ বেঁচে থাকার চিন্তা। কাল কী হবে তার চিন্তা। বছরভর দু’বেলা খেতে পাওয়ার চিন্তা। কয়েক জনের মৃত্যু কয়েকটা পরিবারেই শুধু এই চিন্তাটা বয়ে নিয়ে এল এমন নয়, এ চিন্তা আরও অনেক পরিবারের বছরের পর বছরের দুশ্চিন্তার বিষয়।

রওশনারা, মাবিয়ারা হারিয়েছেন তাঁদের স্বামীকে। পারভীন, রহিমা, সুহানারা হারিয়েছেন তাঁদের বাবাকে। পরিবার হারিয়েছে একমাত্র রোজগেরে সদস্যকে। মঙ্গলবার প্রায় মাঝরাতে, সাগরদিঘি থানার পুলিশ এসে স্বামীর মৃত্যু সংবাদ শুনিয়েছিল রওশনারাকে। তার পর ১২ ঘণ্টাও কাটেনি। চোখের কোলে জলের দাগ স্পষ্ট। তার মধ্যেও স্বামী-সহ গোটা পরিবারের সরকারি সমস্ত নথি এক জায়গায় করে গুছিয়ে রাখছেন তিনি।

কামরুদ্দিনের বাড়িতে মানুষের ভিড়। ছবি: পিটিআই।

একই ভাবে রফিক শেখের বড় মেয়ে বাবার আধার কার্ডের ফটোকপি দেখিয়ে বললেন, ‘‘নামটা ঠিক করে লিখবেন। বয়সটাও।” শোকের আবহেও প্রত্যেকে সজাগ। পাশের মসজিদ থেকেও মাইকে ঘোষণা হচ্ছে। প্রত্যেকে যেন নিজেদের কাগজপত্র তৈরি রাখেন। দেহ পেতে যেমন লাগবে এই সব নথি, তেমনই লাগবে সরকারি সাহায্য পেতেও।

আরও পড়ুন: কাশ্মীর ছেড়ে আজই ওঁদের রওনা দেওয়ার কথা ছিল, সাগরদিঘির গ্রামে হাহাকারে মিশে আক্ষেপ​

কেউ কেউ এর মধ্যেই বলে উঠেছেন— আর কেউ এ গ্রাম থেকে কোনও দিন কাশ্মীরে যাবে না। পরক্ষণেই শোনা যায় উল্টো স্বর— না গিয়ে কোনও উপায় আছে কি! গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য মুস্তাফিজুর রহমান শোনালেন বাহালনগরের মানুষের জীবন সংগ্রামের সঙ্গে কী ভাবে অবিচ্ছেদ্য ভাবে জুড়ে গিয়েছে কাশ্মীর। বললেন, ‘‘এর ইতিহাস অনেক পুরনো। মনিরুল ইসলাম নামে আমাদের গ্রামের একজন, খুব অল্প বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। অনেক দিন নিরুদ্দেশ থাকার পর সে গ্রামে ফিরে আসে। যখন ফিরে আসে তখন সে বেশ পয়সাওয়ালা।” মনিরুলই গ্রামের সকলকে গল্প করে কী ভাবে সে কাশ্মীরে পৌঁছয়... সেখানে কেমন বেশি মজুরি পাওয়া যায়... এই সব কথা।

রফিক শেখের বাড়িতে স্থানীয়রা। —নিজস্ব চিত্র।

সেখান থেকেই শুরু। মনিরুলের হাত ধরেই শুরু হয় গ্রামের মানুষদের কাশ্মীর যাওয়া। মধ্য পঞ্চাশের বক্কর আলি পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। সোজাসাপটাই বললেন, ‘‘এই গ্রামের মানুষকে বাঁচিয়ে দিয়েছে মানি (মনিরুলের ডাক নাম)। না হলে সারা বছর আমাদের খাওয়াই জুটত না।” উপস্থিত মহিলা-পুরুষ সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে নিলেন সেই কথা— গোটা গ্রামের অর্থনীতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কাশ্মীর। স্বীকার করেন পঞ্চায়েত সদস্য মুস্তাফিজুরও। তিনি জানালেন, ‘‘ওখানে এ বছর সবচেয়ে কম মজুরি দিনে ৫০০ টাকা। খাওয়া ফ্রি। কোনও কোনও কাজে মজুরি ৭০০ টাকাও আছে। এখানে কোন কাজটা করে ওই টাকা পাবে!”

গ্রামের মানুষেরা সবাই একমত, আশে পাশে এমন কোনও জায়গা নেই যেখানে কাজ করে ওই টাকাটা পাওয়া যাবে। তার থেকেও বড় কথা, গ্রামে থাকলে সারা বছর কাজই তো জোটে না। বক্কর আলির কথা শুনে মনে পড়ল, এই সব মানুষদের কাজ জোগানোর জন্যই সরকারের ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প। পঞ্চায়েত সদস্যকে সেই ১০০ দিনের কাজের কথা জিজ্ঞাসা করতেই কাষ্ঠ হাসি হেসে বলেন, ‘‘এ বছর গ্রামে একটা কবরখানার সংস্কার ছাড়া তেমন কিছু হয়নি। খুব বেশি হলে ৩০ দিনের কাজ।”

রফিকুল শেখের স্ত্রী ও বাচ্চারা। —নিজস্ব চিত্র।

আরও পড়ুন: আপেলবাগানে জঙ্গিদের দেখাই কি কাল হল ওঁদের! ভাত আনতে গিয়ে বেঁচে গেলেন টিপু

মৃতদের স্ত্রী-পরিবারের একটাই কথা, ‘‘এখানে কাজ থাকলে কী আর সবাই অত দূরে যায়? কাজ দিক সরকার।” পরভীন, মাবিয়ারা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জানেন— দাবি জানানো সোজা, কিন্ত সেই দাবি পূরণ হওয়া কঠিন। তাই শোক সঙ্গে নিয়েই বাঁচার লড়াইয়ে শামিল বাহালনগর। কারণ গোটা গ্রামের প্রায় তিন হাজার মানুষের মধ্যে রফিক, বক্কর, মিরাজদের মতো দিন মজুর মানুষের সংখ্যাটাই বেশি। কাশ্মীর থেকে যতই লাশ হয়ে ফিরুন কয়েক জন, জীবিতদের বেঁচে থাকতে গেলে সেই কাশ্মীরে না গিয়ে কোনও উপায় থাকবে কি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE