Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Mujib Barsha

শুরু হল মুজিববর্ষ: একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি

১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মদিন। দেশ গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে শুরু করল বছর জুড়ে আয়োজন।

মুজিবুর রহমান। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ

মুজিবুর রহমান। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ

অঞ্জন রায়
ঢাকা শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২০ ১৮:০৯
Share: Save:

শুরু হলো মুজিববর্ষ। যে মানুষটি বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ও তার নাগরিকদের আত্মপরিচয় নির্মাণ করে দিয়েছেন আজ তাঁরই জন্ম শতবর্ষে দেশ গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে শুরু করল বছর জুড়ে আয়োজন। আজ, ১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মদিন।

১৯৭১ সালের ৭মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তাঁর উচ্চারণ ছিলো— “আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই।“ সেই ভাষণের সমাপ্তিতে তিনি বলেছিলেন— “মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।“ সেই আহবানে সেদিন একটি নিরস্ত্র জাতি পরিণত হয়েছিলো সশস্ত্র যোদ্ধায়।

একশো বছর আগের কথা, স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল ভারতবর্ষ।একদিকে বিপ্লবীদের বোমা পিস্তল হাতে সশস্ত্র লড়াই– অন্যদিকে গাঁধীর অহিংস স্বাধীনতার আন্দোলন সবে মাথা তুলছে। সেই সময়েই ১৯২০-র ১৭ মার্চ এখনকার বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্ম নিলো একটি শিশু– বাবা শেখ লুৎফর রহমান, মা মোসাম্মৎ সাহারা খাতুন। এই দম্পতির ছয় সন্তানের তৃতীয় সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর আদরের ডাকনাম খোকা। ৭ বছরে খোকা ভর্তি হল স্থানীয় গিমাডাঙা প্রাইমারি স্কুলে, নয় বছর বয়সে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি, পরে স্থানীয় মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। মনে পড়ছে, ১৯৩৯ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহিদ সুরাবর্দি এসেছিলেন গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল পরিদর্শনে। তাঁদের সামনে এগিয়ে এলেন মুজিব। দাবি তুললেন– স্কুলের ছাদ দিয়ে জল পড়ে, সেটি সারানো এবং ছাত্রাবাসের সংস্কারের। সেই প্রথম কোনও দাবি নিয়ে শেখ মুজিবের দাঁড়ানো।

বঙ্গবন্ধু ১৯৪০ নাগাদ সক্রিয় হয়ে ওঠেন রাজনীতিতে। নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে গোপালগঞ্জ মুসলিম ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারির দায়িত্ব পেলেন। ১৯৪২ সালে পাশ করলেন এসএসসি। এবারে শিক্ষার জন্য গেলেন কলকাতায়। ভর্তি হলেন ইসলামিয়া কলেজে মানবিক বিভাগের ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে। থাকতেন বেকার হস্টেলে। পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন এই সময়েই মুজিব। ১৯৪৬ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৭-এ বিএ পাশ করেন। সেই বছরের কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়।

আরও পড়ুন: করোনার প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার? পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু আমেরিকায়

সাংবাদিক বৈঠকে বঙ্গবন্ধু। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ

১৯৪৮ সালে ঢাকায় ফিরে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। প্রতিষ্ঠা করলেন মুসলিম ছাত্রলিগ। সেই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন আইন পরিষদে ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে’— এমন ঘোষণা করলে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে মুখর হন মুজিবুর। বাংলা ভাষা নিয়ে মুসলিম লিগের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ১১ মার্চ ভাষার দাবিতে ধর্মঘট পালন কালে মুজিব ও তার কয়েকজন সহকর্মী গ্রেফতার হন।এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে শুরু হয় দেশ জুড়ে ছাত্র আন্দোলন। মুসলিম লিগ সরকার সবাইকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামি মুসলিম লিগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু। তখন তিনি কারাগারে থাকলেও দলের এই দায়িত্ব তাঁকেই নিতে হয়েছিল। কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পরই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান ঢাকায় এলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বের হয় বিশাল ভুখা মিছিল। সেই মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ১৪ অক্টোবর আবারও তিনি গ্রেফতার হয়ে টানা দু’বছর পাঁচ মাস জেলে বন্দি থাকেন।

১৯৫২ সালে কারাবন্দি অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধু ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘রাজবন্দি মুক্তি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতি আহ্বান জানান। ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে বঙ্গবন্ধু জেলে অনশন শুরু করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্র সমাজ ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল করার সময়ে পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর শহিদ হন। বঙ্গবন্ধু জেল থেকেই তাঁর বিবৃতিতে ছাত্র মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। চলতে থাকে টানা ১৭ দিন অনশন। পাকিস্তানি শাসকেরা ঢাকা জেল থেকে ফরিদপুর জেলে সরিয়ে নেয় মুজিবকে। আন্দোলনের চাপে ২৬ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেল থেকে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয় তাঁকে মুক্তি দিতে।

১৯৫৩ সালে পাকিস্তান আওয়ামি মুসলিম লিগের কাউন্সিলে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ প্রথম সাধারণ নির্বাচনে জিতে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক সরকারের কৃষি ও বনমন্ত্রী হন, কিন্তু ৩০ মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্টের এই মন্ত্রিসভা বাতিল ঘোষণা করে। সেই দিনই আবারও গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু। ২৩ ডিসেম্বর মুক্তি পান তিনি।

১৯৫৫ সালে ঢাকার পল্টনে বিশাল এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি নিয়ে ২১ দফা দাবি ঘোষণা করেন। একই বছরের ২১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় অবস্থানে আওয়ামী মুসলিম লিগের কাউন্সিলে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ পড়ে। বঙ্গবন্ধু আবারও দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

জনসভায় বক্তৃতা বঙ্গবন্ধুর। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ

আরও পড়ুন: ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি, ঘরবন্দি থাকুন’, লকডাউন ঘোষণা এ বার ফ্রান্সে

১৯৫৮ সালে সামরিক বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় । এক বছরের বেশি সময় জেলে আটক রেখে তাঁকে মুক্তি দিয়ে আবারও জেল গেট থেকেই গ্রেফতার করা হয়। তিনি মুক্ত হয়েই ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬২-তে আবারও গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু। সে বছরেই ৪ বছরের সেনা শাসনের অবসানে ১৮ জুন মুক্তি পান মুজিব।

১৯৬৬ সালে লাহৌরে বিরোধী দলের এক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবি পেশ করেন।এ বছরেই তিনি আওয়ামি লিগের সভাপতি হন। ১৯৬৮-সালে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে মোট ৩৫ জন বাঙালি সেনা ও সিএসপি অফিসারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগে বিখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা মামলা দায়ের করে। বঙ্গবন্ধুকে ঢাকার সেনানিবাসে আটক রাখা হয়।

বঙ্গবন্ধু-সহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্তদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। ঢাকা সেনানিবাসে শক্ত নিরাপত্তা বলয়ের মাঝে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের বিচার শুরু হয়। কিন্তু কোটি মানুষের আন্দোলনে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার সেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধু সহ সবাইকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পরদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১০ লাখের বেশি জমায়েতের এক সংবর্ধনায় শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়।

এই বছরের ১০ মার্চ রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধু আওয়ামি লিগের ৬ দফা ও ছাত্র সমাজের ১১ দফা দাবি তুলে বলেন, “গণ-অসন্তোষ নিরসনে ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।“ বঙ্গবন্ধুর দাবি অগ্রাহ্য হওয়ায় ১৩ মার্চ তিনি গোলটেবিল বৈঠক ছেড়ে ঢাকায় ফিরে আসেন।

আরও পড়ুন: ‘চিনা ভাইরাস’ বললেন ট্রাম্প, করোনা নিয়ে দোষারোপ জারি

এর মাঝেই জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতাসীন হন। সুরাবর্দির মৃত্যুদিবসে আওয়ামি লিগের সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। সেদিন তিনি সরাসরি বলেন, “জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি— আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।“

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামি লিগ জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন ও প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ৩০৫টি আসন পায়।

আসে বাঙালির স্বাধীনতার বছর ১৯৭১। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ঢাকার রেসকোর্স মাঠের জনসভায় বঙ্গবন্ধু জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন– বঙ্গবন্ধু পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত হন। ২৮ জানুয়ারি জুলফিকার আলি ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন। এই বৈঠকে ব্যর্থ হলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বান করেন। এদিকে ভুট্টো ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক বয়কটের ঘোষণা করে দুই প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দলের প্রতি ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি তোলেন।

১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলে আগুন জ্বলে ওঠে। ৭ মার্চ রেসকোর্সে এদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।“ এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বাঙালি যেন স্পর্শ করে তার নিজস্ব স্বাধীন ভূমিখণ্ড। “প্রত্যেকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে মোকাবেলা করতে হবে।“ তিনি এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশ্য প্রস্তুতি।

পুরো বাংলদেশ চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। ১৬ মার্চ ঢাকায় ক্ষমতা হস্তান্তর প্রসঙ্গ মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকে আলোচনার জন্য ভুট্টোও ঢাকায় আসেন। ২৫ মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর সন্ধ্যায় ইয়াহিয়ারা ঢাকা ছাড়েন পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে। ২৫ মার্চ রাতে বাঙালির ওপর পাকিস্তানি সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে, শুরু হয় পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়াবহ গণহত্যা— অপারেশন সার্চলাইট। পাকিস্তানি সেনারা কামান, ট্যাঙ্ক নিয়ে হামলা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা রাইফেল সদর দফতর ও রাজারবাগ পুলিশ সদর দফতর। বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন– “This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh. Final victory is ours.”

আরও পড়ুন: করোনায় দেউলিয়া হতে পারে বহু বিমান সংস্থা, হুঁশিয়ারি অস্ট্রেলীয় প্রতিষ্ঠানের

বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বান বেতারে তাৎক্ষণিক বিশেষ ব্যবস্থায় সারা দেশে পাঠানো হয়। রাতেই এই বার্তা পেয়ে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাসে বাঙালি সেনা ও অফিসাররা প্রস্তুত হতে শুরু করেন স্বাধীনতা লড়াইয়ের জন্য। এই রাতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১-১০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং ২৬ মার্চ তাঁকে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তান নিয়ে যায়। ২৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া আওয়ামি লিগকে নিষিদ্ধ করে বঙ্গবন্ধুকে ‘দেশদ্রোহী’ বলে ঘোষণা করেন।

১০ এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে (মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সরকারে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পরিচালনায় এই মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তা ছিল অনন্য। প্রায় এক কোটি শণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত হয়ে আছে।

১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স মাঠে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বিজয়ী হয়। অর্জিত হয় স্বাধীনতা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের লায়ালপুর সামরিক জেলে বঙ্গবন্ধুকে গোপন বিচারে ‘দেশদ্রোহী’ ঘোষণা করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, খোঁড়া হয়েছিলো সেলের পাশেই তাঁর জন্য কবর।

স্বাধীনতার পর ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদানের দাবি জানানো হয়। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন চাপ দিতে থাকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য। বিশ্বের আরও অনেক দেশ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশে আহ্বান জানায়।

১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। জুলফিকার আলি ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বঙ্গবন্ধুকে লন্ডন পাঠানো হয়। ৯ জানুয়ারি লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দেখা হয়। লন্ডন থেকে ঢাকা আসার সময়ে তিনি দিল্লিতে থামেন। বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান।

আরও পড়ুন: করোনার ছায়া মার্কিন অর্থনীতিতেও, গত তিন দশকে রেকর্ড ধস ওয়াল স্ট্রিটে

দমদমে ইন্দিরা গাঁধী ও বঙ্গবন্ধু। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ

বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ঢাকায় নেমেই বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে ভাষণ দেন। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। ৬ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকারের আমন্ত্রণে তিনি সেখানে যান। এই বছরের ১২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ভারতীয় মিত্র বাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করে। ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষর করেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হয়।

১৫ অগস্ট ভোরে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের বাড়িতে সেনাবাহিনীর কিছু অফিসারের হাতে নিহত হন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা, জ্যেষ্ঠ পুত্র মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, পুত্র শেখ জামাল, কনিষ্ঠ শিশুপুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল-সহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও আত্মীয়কে ঘাতকরা হত্যা করে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বাংলাদেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।

১৯৯৬-এর ২৩ জুন বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় সংসদ কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করে। এরপর মুজিব-হত্যাকারীদের বিচার শেষে দণ্ড কার্যকর করা হয় ২০১০-এর ২৮ জানুয়ারি। ওইদিন বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হলেও এখনও কয়েকজন ঘাতক লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের বাইরে।তাদের ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকরের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

১০০ বছর আগে যে জনপদ ছিল পিছিয়ে থাকা, পরাধীন, সেই জনপদের মানুষকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন একজন দীর্ঘকায় বাঙালি। দিয়েছিলেন নিজস্ব ঠিকানা। আজ নেই মানুষটির জন্ম শতবার্ষিকী। বাংলাদেশ আজ বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে তাদের দেশটির নির্মাতাকে। সর্বত্র আজ ধ্বনিত হচ্ছে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা সেই বিখ্যাত গানটি– “শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি/ আকাশে বাতাসে ওঠে রণী/ বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ”। গানটির সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী অংশুমান রায়। এই গানটি প্রথম ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের মাঝে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে 'সংবাদ পরিক্রমা'-য় বাজানো হয়েছিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE