Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Madan Lal

সে দিন নিজের জন্য খেলছিলাম: মদন লাল।। রিচার্ডস-লয়েডের জন্য আলাদা পরিকল্পনা ছিল: রজার বিনি

১৯৮৩ সালের ২৫ জুন লর্ডসে ইতিহাস গড়েছিল কপিল দেবের দল। ৩৭ বছর আগের সেই ঐতিহাসিক দিনকেই আনন্দবাজার ডিজিটালের কাছে ফিরে দেখলেন বিশ্বজয়ের অন্যতম দুই নায়ক মদন লাল ও রজার বিনি।

কপিলের হাতে বিশ্বকাপ। লর্ডসে ১৯৮৩ সালের ২৫ জুন। —ফাইল চিত্র।

কপিলের হাতে বিশ্বকাপ। লর্ডসে ১৯৮৩ সালের ২৫ জুন। —ফাইল চিত্র।

সৌরাংশু দেবনাথ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০২০ ১৫:০৫
Share: Save:

২৫ জুন। ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে বাঁধানো দিন। ১৯৮৩ সালের এই দিনেই লর্ডসে ইতিহাস গড়েছিল কপিল দেবের দল। টানা দু’বারের বিশ্বকাপজয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে ঘটিয়েছিল সেরা অঘটন। তার পর কেটে গিয়েছে এত বছর। তবু সেই জয়ের আবেদন কমেনি একটুও। এখনও ক্রিকেটপ্রেমীদের স্মৃতিতে তা উজ্জ্বল। ৩৭ বছর আগের সেই ঐতিহাসিক দিনকেই আনন্দবাজার ডিজিটালের কাছে ফিরে দেখলেন বিশ্বজয়ের অন্যতম দুই নায়ক মদন লালরজার বিনি

সেই বিশ্বকাপ জয়কে এখন ফিরে দেখতে হলে কেমন অনুভূতি হয়? সে দিনের উন্মাদনা কতটা টের পান?

মদন লাল: ওই মুহূর্ত যে ঠিক কেমন ছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা মুশকিল। খুব ভাল যে ছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু কতটা ভাল, তা বোঝানো অসম্ভব। যে কোনও বড় জয়েরই আলাদা একটা স্বাদ আছে, মাধুর্য রয়েছে। সেখানে বিশ্বকাপ জেতা! প্রথম বারের জন্য। বিশাল বড় জয় ছিল ওটা। সবকিছুই আমাদের বিরুদ্ধে ছিল। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়ে আমরা ট্রফি ছিনিয়ে এনেছিলাম। আচ্ছা লাগতা হ্যায়।

রজার বিনি: এই দিনটা কখনওই ভুলতে পারব না আমরা। বিশ্বকাপ জয় আমাদের জীবনই পাল্টে দিয়েছিল। শুধু আমাদের জীবনই বা কেন, এই জয় ভারতীয় ক্রিকেটের চেহারাই বদলে দিয়েছিল। ২৫ জুন, লর্ডসের পর আমাদের চারপাশ আর আগের মতো ছিল না। ওই মুহূর্ত তাই চেষ্টা করলেও ভোলা যাবে না। শুধু আমি নই, আমরা সবাই এখনও শিহরিত হই বিশ্বকাপ জেতার আনন্দে।

আরও পড়ুন: দলে নেই গাওস্কর-দ্রাবিড়-কোহালি! সেরা টেস্ট একাদশ বেছে ট্রোলড পীযূষ চাওলা

মদনলাল, ফাইনালে আপনি ৩১ রানে তিন উইকেট নিয়েছিলেন। ডেসমন্ড হেইনস, ভিভ রিচার্ডস ও ল্যারি গোমস। এর মধ্যে রিচার্ডসের উইকেটই ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। শোনা যায়, আপনি আরও এক ওভার বাড়তি চেয়ে নিয়েছিলেন। তাতেই আসে উইকেট।

মদন লাল: হ্যাঁ, আমার মাথায় এটাই ঘুরছিল যে উইকেট নিতেই হবে। যে ভাবেই হোক না কেন রিচার্ডসকে ফেরাতে হবে। না হলে ম্যাচ বের করা যাবে না। আমি নিজেকে মেলে ধরতে বদ্ধপরিকর ছিলাম। ওই দিন একদম নিজের জন্য খেলছিলাম। আই ওয়াজ প্লেয়িং ফর মাইসেলফ। উইকেট নিতে হবে, জেতাতেই হবে দলকে।

বিশ্বকাপ ফাইনালে ৩১ রানে তিন উইকেট নিয়েছিলেন মদন লাল। —ফাইল চিত্র।

আপনি তো বিশ্বকাপের আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়েও রিচার্ডসের উইকেট নিয়েছিলেন। অ্যালবিয়নে সিরিজের দ্বিতীয় এক দিনের ম্যাচে বোল্ড করেছিলেন ভিভকে। ফাইনালে পরিকল্পনা কী ছিল?

মদন লাল: আগে আউট করেছিলাম বলে আত্মবিশ্বাস ছিলই যে, ওকেও ফেরানো সম্ভব। আমি বল ঠিকঠাকই করছিলাম। কিন্তু ও ছিল বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান। প্ল্যানিং একটা ছিলই। কিন্তু ভাল বলকেও মেরে দিত রিচার্ডস।

রিচার্ডস যখন মারছিলেন, তখন ভারতীয় সমর্থকদের অনেকেই মাঠ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। আপনাদের মনেও কি কখনও এমন ভাবনা এসেছিল যে ম্যাচ বেরিয়ে যাচ্ছে?

মদন লাল: না, এমন মনে হয়নি। কারণ, আমরা জানপ্রাণ হয়ে লড়ছিলাম। উল্টো দিকে উইকেটও পড়ছিল। রিচার্ডস আউট হওয়ার ঠিক আগেই হেইনসকে ফিরিয়েছিলাম। এটা জানতাম যে উইকেট পড়তে থাকলে চাপ বাড়বেই। ফলে আমাদের মনে আশাও ছিল। এমন ভাবিনি যে ম্যাচ বেরিয়ে গিয়েছে।

রজার বিনি: রিচার্ডস যে ভাবে ব্যাট করে তাতে দাপট মিশে থাকে। বোলারদের আত্মবিশ্বাস শুষে নেয় ও। ফাইনালেও যে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ব্যাট করছিল, বিপদ বাড়ছিল। প্রত্যেক বলই চালাচ্ছিল। রিচার্ডসের উইকেটই ম্যাচে ফিরিয়ে আনে আমাদের। পতন শুরু হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের।

রজার বিনি, আপনি ফাইনালে ফিরিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েডকে। পরিকল্পনা কী ছিল?

রজার বিনি: লয়েড খুব একটা স্বচ্ছন্দ ছিল না। ওর হ্যামস্ট্রিংয়ে টান ধরেছিল। আগের বলেই রান নিতে গিয়ে মুশকিলে পড়েছিল। আমরা তখন ঠিক করেছিলাম, শরীরের কাছাকাছি বল করব না। শরীর থেকে দূরে পা বাড়িয়ে খেলতে হয়, এমন বল করব লয়েডকে। যাতে ও সমস্যায় পড়ে। ও তখন হিটিং থ্রু দ্য লাইন মারছিল। সেই পরিকল্পনার ফসলই ওর উইকেট। খুব জোরে মেরেছিল। খুব দ্রুত বল গিয়েছিল কভারে কপিলের হাতে।

কপি‌ল এর আগেই রিচার্ডসের অবিশ্বাস্য ক্যাচ নিয়েছিলেন অনেকটা দৌড়ে গিয়ে।

রজার বিনি: ওটা ছিল ফাইনালের গতিপথ পাল্টে দেওয়া ক্যাচ। রিচার্ডস খুব মারছিল। মদনের বলটা ভাল ছিল। একটু দেরিতে এসেছিল। সিম করেছিল। বাকি কাজটুকু সেরেছিল কপিল।

বিশ্বকাপ ফাইনালে ১০ ওভারে ২৩ রান দিয়ে লয়েডের উইকেট নিয়েছিলেন রজার বিনি। —ফাইল চিত্র।

কপিলের ওই ক্যাচ ফাইনালের গেম-চেঞ্জিং ছিল। তার আগে জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে ম্যাচে কপিলের ১৭৫ আবার অমূল্য ছিল ভারতের কাছে।

রজার বিনি: সেই ম্যাচে ১৭ রানে পাঁচ উইকেট পড়ে গিয়েছিল। যদি হেরে যেতাম, তা হলে বিশ্বকাপে সমস্যায় পড়ে যেতাম। খুব কঠিন পরিস্থিতিতে ছিল আমাদের ইনিংস। সেখান থেকে কপিল দেখিয়ে দিল, কী ভাবে খেলা যায়। অসাধারণ ইনিংস। চাক্ষুস না করলে যা বিশ্বাস করা অসম্ভব।

বিশ্বকাপ জেতার চেয়ে মধুর মুহূর্ত নিশ্চয়ই জীবনে আসেনি?

মদন লাল: বিশ্বকাপ মানে বিশ্বকাপ। জীবনের সেরা মুহূর্ত, জীবনের সেরা ম্যাচ। এর চেয়ে স্মরণীয় আর কিছু হতে পারে না।

রজার বিনি: আগেই তো বলেছি, বিশ্বকাপ জেতার পর বদলে গিয়েছিল সবকিছু। চিরস্মরণীয় মুহূর্ত।

আরও পড়ুন: ভিভ আউট! টাইগার বলল, ম্যাচটা ঘুরছে​

বিশ্বকাপ জয় পাল্টে দিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটের নকশাই।

মদন লাল: তার আগেও ক্রিকেট জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু তার পর ক্রিকেট উন্মাদনায় পরিণত হল। এখন দেখুন না, ভারত বিশ্বের সেরা দল। আমাদের বোর্ড বিশ্বের সবচেয়ে ধনী। এর পিছনে জগমোহন ডালমিয়া আর আইএস বিন্দ্রার প্রচুর অবদান। ক্রিকেট আজ যেখানে পৌঁছেছে, তার নেপথ্যে এই দু’জনই।

১৯৮৩ সালের আপনাদের বিশ্বজয়ী দল। ২০১১ সালে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির বিশ্বকাপজয়ী দল। আর ১৯৮৫ সালে সুনীল গাওস্করের ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী দল। কোন দল এগিয়ে থাকবে?

মদন লাল: বলা মুশকিল। এ ভাবে তুলনা করা যায় নাকি! যে দল জেতে তারাই সেরা। ভাল দল হয়েও না জিততে পারলে লাভ নেই। এই তিন দলই সফল। ২০১১ সালের দলও খুব ভাল। ধোনি ওয়াজ দ্য বেস্ট ক্যাপ্টেন। ওরা দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেছিল। খুব ভাল দল ছিল ওরা।

রজার বিনি: দেখুন, ২০১১ সালে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম আমরা। দেশের মাঠে খেলেছিলাম আমরা। ওটা ছিল আমাদের শক্তি। কিন্তু ১৯৮৩ সালে আমরা ইংল্যান্ডের মাটিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। এর কৃতিত্ব বেশি। কারণ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখন আনবিটেবল ছিল। আগের দুটো বিশ্বকাপে ওরাই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। লয়েডের সেই দলের জাতটাই ছিল আলাদা। বলতে গেলে, ওদের হারানো যেত না কোনও ভাবে। আর ২০১১ সালের আগেও ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে আমাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দারুণ সুযোগ ছিল। সে বারও ভাল খেলেছিলাম। কিন্তু ট্রফি জিততে পারিনি। আবার ’৮৩-র কথায় আসি। সে বার আমরা বড় বড় দলকে হারিয়েছিলাম। ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, সেমিফাইনালে ইংল্যান্ড, তার আগে অস্ট্রেলিয়া। আর সেই ফর্মটাই আমরা দু’বছর পর অস্ট্রেলিয়ায় ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে দেখিয়েছিলাম।

বিশ্বকাপ জয়ের সেই মুহূর্ত। মাঠে ঢুকে পড়েছেন দর্শকরা। —ফাইল চিত্র।

উইজডেন সম্প্রতি অনলাইনে জনমত সমীক্ষায় গত ৫০ বছরে ভারতের সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে রাহুল দ্রাবিড়কে বেছে নিয়েছে। সুনীল গাওস্কর, সচিন তেন্ডুলকর নাকি দ্রাবিড়, কাকে সেরা বলে মনে করেন?

মদন লাল: সুনীল গাওস্করের চেয়ে বড় ক্রিকেটার কেউ জন্মায়নি। সুনীলই সবার সেরা।

রজার বিনি: এটা বলা খুব কঠিন। কঠিন পরিস্থিতিতে সিম-সুইং-গতি সামলে কে কী ভাবে দলকে টেনেছে, সেগুলো বিচার্য এ ক্ষেত্রে। এর মধ্যে সচিন সবচেয়ে বেশি রান করেছে। তবে তিন জনের মধ্যে এক জনকে এগিয়ে রাখা সহজ নয়। না, সুনীল, সচিন বা দ্রাবিড়, প্রতিভার দিক দিয়েও কাউকে বাছা মুশকিল। তিন জনই ব্রিলিয়ান্ট ব্যাটসম্যান।

আপনার ভোট কে পাবে, সেটাই বলুন।

রজার বিনি: (হেসে ফেলে) নিজের রাজ্যের বলে আমি তো রাহুল দ্রাবিড়ের কথাই বলতে পারি। না, কোনও এক জনকে বাছতে পারছি না। তিন জনই সেরা। তিন জনই ভারতের সেরা ব্যাটসম্যান। প্রত্যেকেই নিজস্ব প্রতিভা আর স্টাইলে সেবা করেছে দলকে।

আরও পড়ুন: ‘বরিভলির গলিতে খেলতাম, ভাবিনি এত দূর আসব’​

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE