Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Virat Kohli

‘এ ভাবে ম্যাচ জেতালে এমন পাম্প-আপ সেলিব্রেশন তো করতেই পারে’

বেশ কয়েক বছর ধরেই ‘চেজমাস্টার’ তকমা লেগে গিয়েছে ছাত্রের জার্সিতে। রান তাড়া করে দলকে জেতানোর ক্ষেত্রে ক্রিকেটবিশ্বে এখন কোহালির ধারে-কাছে কাউকে দেখছে না ক্রিকেটবিশ্ব। রাজকুমার শর্মা অবশ্য দাবি করলেন যে, এটা মোটেই কোহালির হালফিলের বৈশিষ্ট্য নয়।

উপ্পলে শুক্রবার বিরাট আরও একবার মুগ্ধ করেছেন বিশেষজ্ঞদের। ছবি: পিটিআই।

উপ্পলে শুক্রবার বিরাট আরও একবার মুগ্ধ করেছেন বিশেষজ্ঞদের। ছবি: পিটিআই।

সৌরাংশু দেবনাথ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৫:৩৩
Share: Save:

হায়দরাবাদ মানেই কব্জির সূক্ষ্ম মোচড় আর নমনীয়তা। মহম্মদ আজহারউদ্দিন, ভিভিএস লক্ষ্ণণ যা শিল্পে পরিণত করেছিলেন। শুক্রবার রাতে নিজামের শহর সাক্ষী থাকল বিরাট কোহালির আরও এক মাস্টারক্লাসের। কব্জির মোচড়ে কেসরিক উইলিয়ামসকে ওয়াইড লং অনের উপর দিয়ে মারা মারা ছক্কা যেমন ক্রিকেট রোমান্টিকদের পক্ষে ভোলা অসম্ভব।

আরও একবার কব্জির মোচড়ে ডিপ মিড উইকেটের উপর দিয়ে মারলেন ছক্কা। এই ক্ষেত্রে বোলার কিয়েরন পোলার্ড। হতাশ ক্যারিবিয়ান অধিনায়কের তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার ছিল না। কেসরিককে মারা লং অফের উপর দিয়ে চোখজুড়নো আপার ড্রাইভে মারা ছক্কাও তেমনই স্মৃতিতে থাকতে বাধ্য ক্রিকেটরসিকদের। বা, তার দু’বল আগেই ইনসাইড-আউট করে মারা ছয়।

ক্রিকেটবিশ্ব যতই অফসাইড-অনসাইডে কোহালির একের পর এক শটে চমৎকৃত হোক, ছোটবেলার কোচ রাজকুমার শর্মা একেবারেই অবাক হচ্ছেন না। শনিবার দুপুরে আনন্দবাজার ডিজিটালকে তিনি বললেন, “দেখুন, এগুলো ওর ইউনিক শট। একেবারেই নিজস্ব। একজন ব্যাটসম্যান ক্রমশ উন্নতি করতে থাকে। এগিয়ে যেতে থাকে। নিত্যনতুন শট আয়ত্ত করতে থাকে। বোলার যেমন ভাবে, এই ব্যাটসম্যানের এটা দুর্বলতা, ওই ব্যাটসম্যানের অন্য দুর্বলতা, তেমনই ব্যাটসম্যানও ভাবে, আগের বার বোলার যেখানে বল করেছিল, এ বার সেখানেই করলে এই শট মারব। বিরাটও সে ভাবে প্র্যাকটিস করে অনবরত। নেটে সেই শট ক্রমাগত মেরে আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। এখন কব্জির সাহায্যে ওয়াইড মিড অনে মারা শট যেমন ওর প্রধান শটগুলোর একটা হয়ে উঠেছে। ও প্ল্যান করেই রাখে। এখানে বল এলে এই শটই মারব!”

আরও পড়ুন: উইলিয়ামসকে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে বিরাট কোহালির এই ‘নোটবুক সেলিব্রেশন’ ভাইরাল সোশ্যাল মিডিয়ায়​

হায়দরাবাদি বিরিয়ানির মতোই সৌরভ ছড়িয়েছে কোহালির শুক্র-রাতের ইনিংস। প্রথম ২০ বলে উঠেছিল মাত্র ২০। তখন ব্যাটে-বলে ঠিকঠাক হচ্ছিল না। ব্যাটের কানায় লেগে বল যাচ্ছিল পিছনে। ক্রিকেটীয় পরিভাষায় যা ‘লেমন কাট’ হিসেবে চিহ্নিত। সেই বিরাটই পরের ৩০ বলে আচমকাই বদলে গেলেন। সুনামির মেজাজে উঠল ৭৪ রান। কী ভাবে হল এই রূপান্তর? রাজকুমারের ব্যাখ্যা, “কোহালির খেলাটাই তো এমন! ও এ ভাবেই প্ল্যান করেছিল, সেটআপ করেছিল রান তাড়াকে। তার জন্য প্রথমে থিতু হয়েছে ক্রিজে, তার পর রানের গতি বাড়িয়েছে যখন ঠিক মনে হয়েছে।”

ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের মতে, যে দিন কোনও কিছু ঠিকঠাক হয় না, টাইমিং আসে না, তখন ভুলভাল শট মেরে আউট হয়ে যান অধিকাংশ ব্যাটসম্যান। কেউ কেউ এই প্রসঙ্গে রোহিত শর্মার কথা বলেছেন। ইনিংসের শুরুতে মনের মতো শট মারতে না পারলে চালাতে যান রোহিত। আর তখনই উইকেট হারান। এখানেই আলাদা বিরাটের এই ইনিংস। গোড়ার দিকে রান করতে পারছিলেন না। আটকে যাচ্ছিলেন। দ্রুত উপলব্ধি করেন যে তিনি হার্ডহিটার নন। তাঁর ব্যাটিং টাইমিংয়ের উপর নির্ভরশীল। তুলে তুলে মেরে দর্শক মনোরঞ্জন নয়, দলকে জয়ের স্টেশনে পৌঁছে দেওয়াই কর্তব্য। আর সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে পাল্টে ফেলেন তিনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ম্যাচের মধ্যে ব্যাট করতে করতে নিজেকে শুধরে নেওয়াই হল গ্রেট ব্যাটসম্যানের লক্ষণ।

চাপেই বেরিয়ে আসে বিরাটের সেরা, বললেন ছোটবেলার কোচ রাজকুমার শর্মা।

ছোটবেলার কোচও যা মানছেন, “আসলে ওর গেমরিডিং এতটাই ভাল যে সেই মতো নিজেকে শুধরে নিতে পারে। বুঝে ফেলেছিল কী সমস্যা হচ্ছে আর কেন ভাল খেলতে পারছে না। তার পর সেই মতো নিজের খেলা পাল্টে ফেলল। এবং যখন দরকার তখন রানের গতি বাড়াল। আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন, মাঝখানে বেশ কিছু খুচরো রানও নিয়েছে। যখন মারার প্রয়োজন, তখন আবার সেটাও করল। ও টার্গেট করে রেখেছিল যে কোন বোলারকে পেটাবে। সেই হিসেবেই ব্যাটিং করল।”

শুধু ব্যাটিংয়ের গিয়ার পাল্টানোর জন্য বা শুধু মুগ্ধতা ছড়ানো শটের জন্যই নয়, টি-টোয়েন্টি কেরিয়ারে বিরাটের সর্বাধিক রানের ইনিংস আরও এক কারণে মনে থাকবে ক্রিকেটপ্রেমীদের। কেসরিক উইলিয়ামসকে ছয় মারার পর তাঁর ‘নোটবুক সেলিব্রেশন’ এর মধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। জয়সূচক শটের পর জার্সিতে পিঠের দিকে তাঁর নামের প্রতি ইঙ্গিত করতে লাগলেন। তার পর শূন্যে মারলেন ঘুঁষি।এর আগে সিঙ্গলস নেওয়ার সময় বাঁ-হাতি বোলার খারি পিয়েরের তাঁকে ধাক্কার ব্যাপারে আম্পায়ারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। পোলার্ডের ইচ্ছাকৃত সময় নষ্টের ব্যাপারেও অবহিত করলেন আম্পায়ারকে। হালফিল যে শান্তশিষ্ট কোহালিকে দেখা যায় মাঠে, তার থেকে একেবারেই আলাদা আগ্রাসী দেখাল তাঁকে। কেন এমন আক্রমণাত্মক মেজাজে, বোঝালেন তাঁর গুরু, “এটা একটা অসাধারণ রান তাড়া ছিল। টি-টোয়েন্টিতে ২০৭ রান তাড়া করা কখনই সহজ নয়। আর উপ্পলের মাঠ কিন্তু বড়, এটা ভুললে চলবে না। ও যে দুরন্ত ইনিংস খেলেছে, সেটাই উত্তেজিত করে তুলেছিল। কারণ, ২০৭ রান তুলেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এত রান তাড়া করার আগে অনেক দলই মনে মনে হার মেনে নেয়। হাল ছেড়ে দেয়। ভেবে ফেলে যে, নাহ, এটা হবে না। আর কোহালি সেটা সম্ভব করল কি না, এক ওভারেরও বেশি বাকি থাকতে। তার মানে এই জয়টা কী দাপটের সঙ্গে এসেছে, সেটা ভাবুন। দলকে এমন একটা ম্যাচ এ ভাবে জেতালে এমন পাম্প-আপ সেলিব্রেশন তো করতেই পারে!”

আরও পড়ুন: কোহালির ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ, রাহুলের তৃতীয় দ্রুততম হাজার... আর যা যা নজির হল হায়দরাবাদে

বেশ কয়েক বছর ধরেই ‘চেজমাস্টার’ তকমা লেগে গিয়েছে ছাত্রের জার্সিতে। রান তাড়া করে দলকে জেতানোর ক্ষেত্রে ক্রিকেটবিশ্বে এখন কোহালির ধারে-কাছে কাউকে দেখছে না ক্রিকেটবিশ্ব। রাজকুমার শর্মা অবশ্য দাবি করলেন যে, এটা মোটেই কোহালির হালফিলের বৈশিষ্ট্য নয়। তাঁর মতে, “ও বরাবরই রান তাড়া করায় দক্ষ। যে কোনও কঠিন পরিস্থিতিতে ও জ্বলে ওঠে। প্রতিকূল অবস্থায় ও ছোট থেকেই বিশ্লেষণ করতে পারে যে বেরনো সম্ভব কোনও উপায়ে। এটা ছোট থেকেই ওর মধ্যে ছিল। আর ও ছোট থেকেই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলেছে। তাই এমন সব পরিস্থিতিতেই ও স্বচ্ছন্দ বোধ করে। নিজেকে আরও বেশি উদ্দীপ্ত করতে পারে। নিজেকেই ও চ্যালেঞ্জ জানায়। আর ছোট বয়স থেকেই এটা ও উপভোগ করে।”

ছয় ছক্কা ও ছয় চার। স্ট্রাইক রেট ১৮৮। উপ্পলের এই ইনিংসের বিশেষত্ব কী? কোচের মূল্যায়ন, “এটা আমার দেখা বিরাটের অন্যতম সেরা ইনিংস। এমনিতে ওর সব ইনিংসই একটা অন্যটার চেয়ে আলাদা। প্রত্যেকটাই ইউনিক। কিন্তু শুক্রবার যে ভাবে রান তাড়া করল, যে ভাবে কোনও চান্স না দিয়ে দলকে টেনে নিয়ে গেল, যে ভাবে অঙ্ক কষে ব্যাট করল, তাতে এটা সেরার মধ্যেই থাকবে। কোনও সন্দেহ নেই, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে এটা ওর অন্যতম সেরা ইনিংস।”

ইডেনে গোলাপি বলের টেস্টে সেঞ্চুরি। তার কয়েক দিনের মধ্যেই টি-টোয়েন্টিতে সেঞ্চুরির চেয়েও দামি এই ৯৪। বিভিন্ন ফরম্যাটে যে মেজাজে ব্যাট করছেন, তাতে বিরাটকে বিশ্বের সেরা মানছে ক্রিকেটমহল। কোচের রায়, “হ্যাঁ, ওই তো সেরা। সবশেষে তো পারফরম্যান্সই বিচার্য। তাই না? নাম যাই হোক, পারফরম্যান্সই দেখতে হয়। আর বিরাটের তো ব্যাটই কথা বলছে। অন্য কারও মুখ খোলার প্রয়োজনই নেই। ব্যাট দিয়েই নিজেকে প্রমাণ করছে ও। এই পারফরম্যান্সের পর বিরাটকে আর দুই নম্বরে রাখা যায় না!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE