Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
BJP's Nabanna March

লাঠি, বোমা, গ্যাসে ধুন্ধুমার, উদ্ধার পিস্তল, শূন্য নবান্ন থেকে দূরেই বিজেপি

বিজেপি যদিও এ দিনের অভিযান রুখতে পুলিশি অত্যাচারের অভিযোগ তুলেছে।

বিজেপি সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে দিনভর উত্তপ্ত রইল দুই শহর। —নিজস্ব চিত্র।

বিজেপি সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে দিনভর উত্তপ্ত রইল দুই শহর। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২০ ২০:০৪
Share: Save:

নবান্ন অভিমুখে মিছিল শান্তিপূর্ণ ভাবে এগিয়ে যাবে। পুলিশ কোথাও আটকালে সেখানেই দাঁড়িয়ে যাবেন কর্মী-সমর্থক-নেতানেত্রীরা। গন্ডগোল, অশান্তির পথে কোনও ভাবেই তাঁরা পা দেবেন না। বৃহস্পতিবারের নবান্ন অভিযান শুরুর আগে এমনটাই শোনা গিয়েছিল বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি মুকুল রায়ের মুখে। কিন্তু সে সব কথার কথাই থেকে গেল। যুব মোর্চার এ দিনের নবান্ন অভিযান ঘিরে কলকাতা ও হাওড়া— দুই শহরেই ধুন্ধুমার বাধল। পুলিশকে লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি ইটবৃষ্টি হল, পড়ল বোমাও। উদ্ধার হল পিস্তল। জলকামানের সঙ্গে চলল পুলিশের লাঠিচার্জ। অনেক জায়গায় পুলিশের সঙ্গে অভিযানকারীদের সঙ্গে ধস্তাধস্তিও হল। সব মিলিয়ে এ দিন বেশ কয়েক ঘণ্টা তুলকালাম চলল গঙ্গাপাড়ের দুই শহরে। কিন্তু অভিযানকারীরা কোনও ভাবে শূন্য নবান্নের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারলেন না।

বিজেপি যদিও এ দিনের অভিযান রুখতে পুলিশি অত্যাচারের অভিযোগ তুলেছে। জলকামানের জলে রাসায়নিক মেশানোর মতো গুরুতর অভিযোগও তোলা হয়েছে তাদের তরফে। বিজেপির যুব মোর্চার সর্বভারতীয় সভাপতি তেজস্বী সূর্য অভিযোগ করেছেন, পুলিশি অত্যাচারে তাঁদের অন্তত ১ হাজার জন কর্মী-সমর্থক আহত হয়েছেন। গ্রেফতার করা হয়েছে প্রায় ৫০০ কর্মী-সমর্থককে। পাশাপাশি তিনি জলকামানের জলে রাসায়নিক মেশানোর অভিযোগ তুলে বলেন, ‘‘পুলিশের মারে আমাদের নেতা রাজু বন্দ্যোপাধ্যায় বমি করেছেন। তিনি হাসপাতালে ভর্তি। বর্বরতার সঙ্গে লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ। জলকামানে ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’’

যদিও রাজ্যের মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, জলে ‘হোলির রং’ ছিল। তার কারণও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। আলাপনের কথায়, ‘‘জলে হোলির রং মেশানো ছিল। বিশ্ব জুড়েই এমনটা করা হয়। বিক্ষোভকারীরা ভিড়ে মিশে গেলেও, পরে তদন্তের প্রয়োজনে জামার রং দেখে তাঁদের শনাক্ত করা যায়।’’ বিজেপি কর্মীদের ছোড়া ইটের আঘাতে বহু পুলিশকর্মী আহত হয়েছেন বলে পাল্টা দাবি করেছেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানান, কলকাতা পুলিশ ৮৯ জন এবং হাওড়া পুলিশ ২৪ জন বিক্ষোভকারীকে আটক করেছে। বিজেপির মিছিল থেকে একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে বলে জানান মুখ্যসচিব। যদিও রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘‘ওই ব্যক্তি বিজেপির এক নেতার দেহরক্ষী। তাঁর কাছে ওই পিস্তলের লাইসেন্স রয়েছে। মিথ্যে অভিযোগে ওঁকে ফাঁসানো হচ্ছে।’’ পুলিশ সূত্রে খবর, জম্মু কাশ্মীরের রাজৌরি থেকে ওই পিস্তলের লাইসেন্স নেওয়া হয়। গোটা ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় বিজেপি কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে লালবাজার।

টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ চলছে। —নিজস্ব চিত্র।

আরও পড়ুন: জলকামান ছুঁতে পারল না দিলীপকে, ১ ঘণ্টার কর্মসূচি হল ‘রীতি’ মেনেই

এ দিনের নবান্ন অভিযানে পুলিশি ভূমিকার নিন্দা করেছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেন, ‘‘দলের অভিজ্ঞ নেতাদের উপর বাংলার পুলিশের নৃশংস আচরণের তীব্র নিন্দা করছে বিজেপি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের অত্যন্ত বিনীত ভাবেই বলব, পুলিশ এবং পুলিশের লাঠি দিয়ে বিজেপিকে রুখতে পারবেন না আপনারা।’’ এ দিনের অভিযানে অন্তত দেড় হাজার বিজেপি কর্মী আহত হয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি।

বিজেপির মিছিল ঘিরে বেশি কিছু দিন ধরেই উত্তাপ বাড়ছিল রাজ্য রাজনীতির। তার মধ্যেই গতকাল বুধবার আচমকা দু’দিনের জন্য নবান্ন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য সরকার। শূন্য নবান্নের উদ্দেশেই এ দিন চার জায়গা থেকে হাজার হাজার বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের মিছিল রওনা হয়। মুরলিধর সেন রোডে বিজেপির সদর দফতর, হেস্টিংসে দলের কার্যালয়, হাওড়া ময়দান এবং সাঁতরাগাছি থেকে মোট চারটি মিছিল বেরোয়।

কিন্তু নবান্নের ধারেকাছে পৌঁছনো তো দূর অস্ত্‌, কিছু দূর এগোতেই চার জায়গায় পুলিশের বাধার মুখে পড়েন বিক্ষোভকারীরা। হাওড়া ঢোকার মুখে, ডানকুনিতে ব্যারিকেড বসিয়ে আগে থেকেই বিশাল পুলিশ বাহিনী মোতায়েন ছিল। তাদের সঙ্গে ছিল জলকামানও। সেখানে বিক্ষোভকারীদের বাস আটকানো হয়। বাধ্য হয়ে রাস্তায় বসে পড়েন বিক্ষোভকারীরা। তাতে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে ২ নম্বর জাতীয় সড়ক। পুলিশ অবরোধ তুলতে এলে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুটে আসতে থাকে। তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে পাল্টা লাঠিচার্জ করে পুলিশ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

সাঁতরাগাছি থেকে বাইকে চেপে রাজ্য বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু ও সহ-সভাপতি রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মিছিলে যোগ দিতে আসছিলেন সমর্থকরা। সেখানে আগে থেকে বাঁশের ব্যারিকেড বসিয়ে রেখেছিল পুলিশ। কিন্তু আন্দোলনকারীরা তা ভেঙে দেন। তাতে দু’পক্ষের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ বেঁধে যায়। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটায় পুলিশ। চালানো হয় জলকামানও। তাতে রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ বেশ কয়েক জন মারাত্মক ভাবে জখম হন।

সেখানেই জলকামান থেকে পুলিশ রাসায়নিক মেশানো নীল রংয়ের জল ছুড়েছিল বলে অভিযোগ করেন বিজেপি নেতৃত্ব। সেই রাসায়নিকের প্রভাবেই রাজু বন্দ্যোপাধ্যায় রক্তবমি করেন এবং তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয় বলে জানানো হয়। হাওড়ায় মিছিলে নেতৃত্ব দিতে আসা তেজস্বী সূর্য পরে বলেন, ‘‘শান্তিপূর্ণ ভাবে মিছিল করছিলাম আমরা। কিন্তু বাংলার পুলিশ মমতার হাতের পুতুল। তাঁরা তৃণমূলের পোষা গুন্ডা। রাজ্য সরকারকে বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছেও আর্জি, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হোক।’’

তবে ভবানীভবনের সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যসচিব জানান, এই মিছিল মহামারি আইনের পরিপন্থী। তা সত্ত্বেও, যথেষ্ট সংযম দেখিয়েছে পুলিশ। চারিদিক থেকে কম প্ররোচনা ছিল না। বিক্ষোভকারীদের কাছ থেকে আগ্নেয়ান্ত্রও মিলেছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিসর রক্ষার্থে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সরকার। পুলিশের সক্রিয়তায় অনভিপ্রেত ঘটনা এড়ানো গিয়েছে। অনেক পুলিশকর্মীও আহত হয়েছেন।

বিক্ষোভকারীদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া যে আগ্নেয়াস্ত্রের কথা বলেছেন মুখ্যসচিব, সেটি হাওড়া ময়দান থেকে এগনো মিছিলে শামিল হওয়া বিজেপি কর্মীর কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় পুলিশ। এ দিন সেখানেই সবচেয়ে বেশি হিংসাত্মক আকার ধারণ করে মিছিল। আগে থেকেই ওই এলাকায় ড্রোনের মাধ্যমে নজরদারি চালাচ্ছিল পুলিশ। মোতায়েন করা ছিল রোবোকপও। মল্লিক ফটকের কাছে বসানো হয়েছিল ব্যারিকেড ও জলকামান। তার পরেও মিছিল এগোতে থাকলে কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটাতে শুরু করে পুলিশ। তাতে গোটা রাস্তা ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়ায় কিছুটা পিছু হটেন বিক্ষোভকারীরা।

কিন্তু পর মুহূর্তেই পুলিশকে লক্ষ্য করে আক্রমণ ধেয়ে আসে। এলোপাথাড়ি ইট-পাটকেল ছোড়া হয়। পর পর বেশ কয়েকটি বোমাও পড়ে। হাওড়া ময়দানের রাস্তায় টায়ার জ্বালান বিজেপি কর্মীরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। তাড়া করে বিজেপির সমর্থকদের সেখান থেকে বার করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সেই সময় ধস্তাধস্তিতে বলবন্ত সিংহ নামের এক বিজেপি সমর্থকের কাছ থেকে ৯ এমএম পিস্তল উদ্ধার করা হয় বলে দাবি পুলিশের। পুলিশ জানিয়েছে, বলবন্ত সিংহ ব্যারাকপুরের সাংসদ তথা রাজ্য বিজেপির সহ-সভাপতি অর্জুন সিংহের শিবিরের লোক।

জলকামানের মুখে বিক্ষোভ বিজেপি সমর্থকদের। —নিজস্ব চিত্র।

আরও পড়ুন: হারানো চটি আর ভাঙা চশমার ভিড়ে রণক্লান্ত হাওড়া ব্রিজ​

হেস্টিংস ও মুরলীধর সেন থেকে বেরনো দু’টি মিছিলও এ দিন রুখে দেয় পুলিশ। হেস্টিংসে ব্যারিকেড টপকাতে গেলে বিজেপি সমর্থকদের উপর লাঠিচার্জ করে পুলিশ। তাতে জখম হন পুরুলিয়ার বিজেপি সাংসদ তথা রাজ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাত। হেলমেট পরে সেখানে পুলিশের হাত থেকে মাথা বাঁচাতে দেখা যায় অর্জুন সিংহকে। পুলিশের জলকামানের মুখে পড়ে হাওড়ার ব্রিজ থেকে ফিরে শেষমেশ পিছু হটে মুরলীধর সেন লেন থেকে বেরনো মিছিলটিও।

পরে এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে ক্ষোভ উগরে দেন দিলীপ ঘোষ ও তেজস্বী সূর্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যাকে আক্রমণের ভার এ দিন তেজস্বীর কাঁধেই তুলে দেন দিলীপ। এই প্রথম বিজেপির হয়ে মিছিলে নামলেন তেজস্বী। কড়া ভাষায় রাজ্যের তৃণমূল সরকার এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনা করেন তেজস্বী। তিনি বলেন, ‘‘দিনের আলোয় গণতন্ত্রকে হত্যা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বর্তমানে বাংলার সরকারই দেশের সবচেয়ে বড় দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার। এখানে প্রতিনিয়ত গণতন্ত্র এবং সংবিধানকে গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছে। এই সরকার কাটমানি এবং সিন্টিকেটের সরকার। তার জেরেই আজ বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু সরকারি দুর্নীতি, বেকারত্বের নিয়ে মুখ খোলার উপায় নেই। তা হলেই খুন করে দেওয়া হবে। গত এক বছরে আমাদের ১২০ জনের বেশি কার্যকর্তা খুন হয়েছেন। বাংলায় আজ গণতন্ত্র বিপন্ন।’’ তেজস্বী আরও বলেন, ‘‘মমতা বিজেপির যুব মোর্চাকে ভয় পেয়েছেন। তাই নবান্ন বন্ধ করে রেখেছেন। তবে এই ভয়টা থাকা ভাল। তবেই বাংলাকে বাঁচানো যাবে। খুব শীঘ্র সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে বাংলায় সরকার গড়বে বিজেপি।’’

জেপি নড্ডার টুইট।

রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে ছাড়েননি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও। দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা টুইটারে লেখেন, ‘‘শান্তিপূর্ণ ভাবে আন্দোলন চলছিল, বিক্ষোভকারীদের দিকে দেশি বোমা ছোড়া এবং জলকামান চালানোর ঘটনাই প্রমাণ করছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অত্যন্ত বিচলিত। কারণ যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে, তা ভাল মতোই বুঝতে পারছেন উনি। এই স্বৈরাচারী সরকারকে আর রাখবেন না বলে ঠিক করে নিয়েছেন বাংলার মানুষ।’’ বিজেপিকে পাল্টা সন্ত্রাসবাদীদের দল বলে আক্রমণ করেন কলকাতা পুরসভার প্রশাসক ফিরহাদ হাকিম। তাঁর কথায়, ‘‘বিজেপি কোনও রাজনৈতিক দল নয়। ওরা সন্ত্রাসবাদী।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE