ভার্চুয়াল সভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
একুশের নির্বাচনে জামানত জব্দ করে দিন বিজেপির— একুশের সভা থেকে ডাক তৃণমূল চেয়ারপার্সন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কোভিড সংক্রমণ এড়াতে এ বছর ধর্মতলায় জমায়েত করে শহিদ স্মরণ করল না তৃণমূল। ভার্চুয়াল সভার আয়োজন করে কালীঘাটে নিজের বাড়ি থেকেই মঙ্গলবার মমতা ভাষণ দিলেন গোটা বাংলার তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে। গায়ের জোরে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের সরকার ভাঙতে চাইছে বলে অভিযোগ করলেন একাধিক বার। শহিদ স্মরণের কর্মসূচি থেকে তাই ‘বদলা’ নেওয়ার আহ্বান জানালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০২১-এর নির্বাচনে বিজেপির জামানত জব্দ করে দিয়ে পরবর্তী ২১ জুলাই সর্ববৃহৎ সভা করতে হবে— একুশের মঞ্চ থেকে এ দিন দলের সামনে এই লক্ষ্যই বেঁধে দিলেন নেত্রী।
আর্থিক বঞ্চনা করে, রাজ্যের প্রাপ্য আটকে রেখে এবং আরও নানা অসহযোগিতা করে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ সরকারক বিপাকে ফেলতে চাইছে— এ দিন বার বার এই অভিযোগ ঘুরে ফিরে এল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘণ্টাখানেকের ভাষণে। শুধু বঞ্চনা বা অসহযোগিতা নয়, একনাগাড়ে তাঁকে অপমান করা হচ্ছে বলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এ দিন দাবি করেন। তাঁর কথায়, ‘‘সারা জীবন সিপিএমের হাতে মার খেতে খেতে আমার সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছে। আর বিজেপির রাজত্বে কথায় কথায় বঞ্চনা, অপমান, অসম্মান, চক্রান্ত।’’
২০১১ সালে ক্ষমতায় এলেও ৮ বছরের বেশি শান্তিতে কাজই করতে দেওয়া হল না তাঁর সরকারকে— এ দিন আক্ষেপের সুরে বলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে কিছু আসন পাওয়ার পর থেকে বিজেপি গোটা বাংলায় নৈরাজ্য তৈরি করছে— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন এমনই বলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘কয়েকটা আসন পেয়ে যেন সারা পৃথিবী জয় করে নিয়েছে। গুন্ডামি করা, হিংসা করা, দাঙ্গা করা, চক্রান্ত করা।’’ করোনা সংক্রমণের মাঝেও বিভিন্ন ইস্যুতে রাস্তায় নেমে বিজেপির হইচইকে যে তিনি মোটেই ভাল চোখে দেখছেন না, তা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। প্রবল উষ্মা নিয়ে মমতা এ দিন বলেন, ‘‘একটা ঘটনা ঘটলেই গাড়িগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে, রাস্তায় বসে পড়ছে। যেন ওর রাস্তা। যেন দিল্লি থেকে এসে রাস্তাগুলো বানিয়ে দিয়ে গিয়েছে।’’ যখন তখন অবরোধ বা অশান্তিতে বহু মানুষকে অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে, জরুরি কাজে অনেকে যেতে পারছেন না, হাসপাতালে যাওয়ার পথে রোগী আটকে যাচ্ছেন— বলেন মুখ্যমন্ত্রী।
২১ জুলাইয়ের ভার্চুয়াল সভায় দলনেত্রীর বার্তা শুনতে উপস্থিত তৃণমূল নেতা-কর্মীরা।
আরও পড়ুন: বাংলাকে গুজরাত চালাবে না, একুশের ভার্চুয়াল সভা থেকে হুঙ্কার মমতার
রেশন দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করেও বিজেপি-সহ বিভিন্ন বিরোধী দল একনাগাড়ে আক্রমণ করছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে। সে প্রসঙ্গে এ দিন ফের মুখ খোলেন মুখ্যমন্ত্রী। একুশের ভার্চুয়াল সভা থেকে তাঁর তোপ, ‘‘অনেক সময় বড্ড মিথ্যে অপপ্রচার হচ্ছে। বলুন তো বাংলায় কত রেশন দোকান। একটা দুটো স্পটে কেউ যদি কোনও গন্ডগোলও করে, সরকার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করেছে। কিন্তু বিজেপি-কংগ্রেস-সিপিএম, যারা বাংলায় সারাক্ষণ লন্ডভন্ড করে বেড়ান, একবারও কি বলেছেন, কোথায় এমন রাজ্য পাবেন, যেখানে লকডাউন ঘোষণার আগেই ফ্রিতে রেশন দেওয়া হবে বলা হয়েছিল?’’
রেশন নিয়ে এ দিন বড় প্রতিশ্রুতিও কিন্তু শুনিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনের আগে যে হেতু এটাই ছিল শেষ একুশে জুলাই, সে হেতু এই মঞ্চ থেকে বড় নির্বাচনী ঘোষণার সুযোগ স্বাভাবিক কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাতছাড়া করতে চাননি। রেশন প্রসঙ্গে বলতে গিয়েই তাঁর ঘোষণা, ‘‘১০ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে রেশন দেওয়া হচ্ছে। এটাও হতে পারে, আমাদের সরকার থাকলে, সারা জীবন বিনামূল্যে রেশন পাবেন, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পাবেন, বিনামূল্যে পড়াশোনার সুযোগ পাবেন, বিনামূল্যে মর্যাদা পাবেন, আত্মসম্মান নিয়ে বাংলা বাঁচবে।’’ রেশন থেকে সারা জীবন বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী দেওয়ার এই ঘোষণা আসন্ন নির্বাচনে তৃণমূলের খুব বড় হাতিয়ার হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিজেপির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলেই অবশ্য থেকে থাকেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বিজেপি-কে তীব্র প্রত্যাঘাতের মুখে দাঁড় করানোর ডাকও মমতা এ দিন দিয়েছেন দলের উদ্দেশে। এ বারের ২১ জুলাই ধর্মতলায় সমাবেশ করা গেল না, কিন্তু আগামী বছর এই তারিখে জমায়েত হবে এবং সর্ববৃহৎ তথা ঐতিহাসিক জমায়েত হবে— ভাষণের শুরুর দিকেই এ কথা বলেন মমতা। কেন সর্ববৃহৎ? মমতা নিজেই দিয়েছেন সে প্রশ্নের উত্তর। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-কে হারিয়ে শহিদ স্মরণের দিনে বিপুল সমাবেশ করবে তৃণমূল— এই বার্তাই আসলে দিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘কেন্দ্র আমাদের বঞ্চনা করেছে। বাংলাকে চিরকাল অসম্মান করা হয় এবং দিনেদুপুরে যে ভাবে তাঁরা আমাদের অসম্মান করছেন, এর বদলা আমরা নেবই।’’ এই ‘বদলা’ শব্দের ব্যাখ্যাও মমতা এ দিন দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এর বদলা আমরা বদলা দিয়ে নেব না, এর বদলা আমরা মানবিকতাকে জয় করে নেব। আর বাংলার মানুষ মাথা উঁচু করে বলবে যে, কেন্দ্রীয় সরকার জেনে রেখ, বহিরাগতরা বাংলা চালাবে না। বাংলা বাংলার লোকেরা চালাবে।’’ নাম না করে নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহকে এ দিন কটাক্ষ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘মনে রাখবেন, বাংলাকে গুজরাত শাসন করবে না, বাংলাই বাংলাকে শাসন করবে।’’
বাংলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বিজেপি আক্রমণের সুর ক্রমশ চড়াচ্ছে। শুধু বাংলার নেতারা নন, দিল্লির নেতারাও মুখ খুলছেন সে ইস্যুতে। হেমতাবাদের বিধায়কের রহস্যমৃত্যুর পরে তো বিজেপির প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে দেখা করে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির দাবি জানিয়ে এসেছে। তার পরে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় বাংলার পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন শাহের সঙ্গে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন সে বৈঠকের কথা উল্লেখ করেননি। তবে বাংলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বিজেপি নেতাদের নানা মন্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘‘একটা দিল্লির সরকার, চক্রান্তের জোতদার! বলছে বাংলায় নাকি আইনশৃঙ্খলা নেই! আমরা বলি, বাংলায় আইনশৃঙ্খলা না থাকলে কোথায় আছে? কী চলছে উত্তরপ্রদেশে? জঙ্গলরাজ বললেও কম হবে।’’
বক্তৃতা দিচ্ছেন ফিরহাদ হাকিম।
বিজেপি-কে ‘বহিরাগত’ হিসেবে এ দিন বার বার চিহ্নিত করতে চেয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘আমি এ দের বলি কোথা থেকে এসেছেন? রাজনৈতিক জন্মটা কোথায়? বাংলায় তো জন্মের থেকে আমরা আছি। আপনাদের নাম তো কখনও শুনিনি, যে রাজনীতি করেছেন। কখনও তো শুনিনি যে, বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কেন্দ্রে ক্ষমতায় আছেন বলে কি গায়ের জোর দেখাচ্ছেন?’’ মমতার হুঙ্কার, ‘‘এত দুর্বল ভাবার কারণ নেই তৃণমূল কংগ্রেসকে। সকাল থেকে রাত অবধি কিছু লোক আছে, কোনও দিন এদের দেখিনি। জীবনে রাজনীতি কাকে বলে জানে না। না আছে আদর্শ, না আছে দর্শন, না আছে চেতনা, না আছে বিবেক, না আছে শুভবুদ্ধি। সকাল থেকে উঠেই জিহ্বা লকলক করছে। সে জিহ্বা দিয়ে একটাও ভাল কথা বেরোয় না। কখনও বলছে এনকাউন্টার করে দেব, কখনও বলছে গুলি মার, কখনও বলছে মেরে ফেল, কখনও বলছে দাঙ্গা কর, জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও!’’
আরও পড়ুন: সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত লকডাউন, কী কী বন্ধ কোথায় ছাড় দেখে নিন
কোভিড নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতির সঙ্গে অন্য কোনও রাজ্যের তুলনা করা উচিত নয় বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন মন্তব্য করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘কোভিড একটু বেড়েছে, কিন্তু চিন্তা করার কোনও কারণ নেই।’’ দিল্লিতে সংক্রমণে কিছুটা রাশ টানা সম্ভব হয়েছে বলে সম্প্রতি নানা মহলে প্রশংসা পেয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সে কথা সরাসরি এ দিন উল্লেখ করেননি মমতা। তবে তিনি বলেন, ‘‘দিল্লি একটা ছোট জায়গা, কলকাতার মতো। গুজরাত বাংলার অর্ধেক। ওড়িশাও ভৌগোলিক সীমা এবং জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলার অর্ধেক। অন্য রাজ্যের সঙ্গে বাংলার তুলনা হয় না।’’
‘শহিদ’দের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।
বাংলায় যাঁরা করোনা আক্রান্ত হয়েছে, তাঁদের ৮৭ শতাংশই উপসর্গহীন বলে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন একুশের সভা থেকে। ৮ শতাংশের মধ্যে উপসর্গ থাকলেও তা মৃদু, বাকি ৫ শতাংশের অবস্থা গুরুতর হচ্ছে বলে তিনি জানান। যত জন আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৬০ শতাংশই ইতিমধ্যে সুস্থ হয়ে গিয়েছেন (ডিসচার্জ রেট) বলে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন মঙ্গলবার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy