Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ওষুধে কাজ হচ্ছে না! চুপ চিকিৎসক

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে বীরভূমের দু’টি লোকসভা আসনেই জয়ী হয়েছে তৃণমূল। জেলার ১১টি বিধানসভা আসনের মধ্যে  ৬টিতে এগিয়ে তৃণমূল।

বীরভূম জেলা তৃণমূল সফাপতি অনুব্রত মণ্ডল। —ফাইল চিত্র

বীরভূম জেলা তৃণমূল সফাপতি অনুব্রত মণ্ডল। —ফাইল চিত্র

ফিরোজ ইসলাম
বোলপুর শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৯ ০৫:০৬
Share: Save:

রোগীর চোখের পাতা পড়ছে, নড়ছে হাত-পা। তবু চিকিৎসকের মনে হচ্ছে, ওষুধ যেন কাজ করছে না।

কারণ, থেকে থেকেই বিদ্রোহ করছে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। উন্নয়ন, পাচন, চড়াম-চড়াম কিংবা নকুল দানা, কোনও ওষুধই আর আগের মতো ফল দিচ্ছে না। বিষণ্ণ চিকিৎসক তাই কিছু দিন ধরে রোগীর স্বাস্থ্য নিয়ে মুখ বন্ধ রেখেছেন। গম্ভীর মুখে শুধুই নাড়ির গতি মেপে যাচ্ছেন।

চিকিৎসককের নীরবতায় উদ্বেগ বাড়ছে রোগীর আত্মীয়-পরিজনদের। তাঁদের বিশ্বাসেও যেন একটু চিড় ধরেছে।

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে বীরভূমের দু’টি লোকসভা আসনেই জয়ী হয়েছে তৃণমূল। জেলার ১১টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৬টিতে এগিয়ে তৃণমূল। বাকি ৫ আসনে এগিয়ে বিজেপি। তবে, বোলপুর, সিউড়ি, দুবরাজপুর, সাঁইথিয়া, রামপুরহাটের পুর এলাকায় এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। এমনকি বোলপুর শহরে তৃণমূলের বীরভূম জেলার সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের ওয়ার্ডেও শাসক দল পিছিয়ে পড়েছে বিজেপির কাছে। অথচ ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শিবনাথ রায় এলাকায় ঘরের লোক বলেই পরিচিত। সাইকেলে ঘুরে বেড়ানো কাউন্সিলর নাগরিকদের প্রয়োজনে প্রায়ই নিজে সংশ্লিষ্ট বাড়িতে পৌঁছে যান বলে খবর। থলিতে যাবতীয় দরকারি শংসাপত্র নিয়ে ঘোরেন। যাতে কারও সময় নষ্ট না হয়। নিরাপত্তার ঘেরাটোপ পেরিয়ে অনুব্রতের কাছে পৌঁছতে না পারা অনেকের কাছেই আর্জি পৌঁছে দেওয়ার মুশকিল আসান শিবনাথ। জনসংযোগের এমন উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও পদ্মের কাছে ওই ওয়ার্ডে শোচনীয় ভাবে পিছিয়ে পড়েছে ঘাসফুল। রোগীর রক্তে অসন্তোষের ‘সংক্রমণ’ চুপিসারে বাসা বাঁধার আশঙ্কায় তাই ঘুম নেই চিকিৎসক এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের।

রাতে বোলপুর স্টেশন থেকে ভুবনডাঙার হোটেলের দিকে যাওয়ার পথে নীরবে ছড়িয়ে পড়া জীবাণুর কথাই বলছিলেন এক টোটোচালক। তাঁর কথায়, ‘‘ফাঁকা বুলি আর কত দিন সহ্য করা যায়। বিরুদ্ধে কিছু বলার জো নেই। মানুষ ভোটে জবাব দিয়েছে। এখন বুঝুক।’’

শাসক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে এই অসন্তোষ আর অভিযোগের কথাই ঘুরে-ফিরে এল বীরভূমের নানা প্রান্ত ঘুরে দেখতে গিয়ে। অনেকেই বললেন, বুথ সভাপতি থেকে পঞ্চায়েত প্রধান, পুরসভার কাউন্সিলর থেকে ওয়ার্ড কমিটির মাথা, শাসক দলে উন্নয়নের আসল ‘সুবিধাভোগীর’ সংখ্যা নেহাত কম নয়।

জনজাতি এলাকায় বঞ্চনাজনিত ক্ষোভের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। সেখানে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প, আবাস যোজনার বাড়ি, পঞ্চায়েতে চাষের সরঞ্জাম বিলি থেকে সামাজিক বনসৃজন প্রকল্পের গাছ, বার্ধক্য কিংবা বিধবা ভাতা, কমবেশি সব ক্ষেত্রেই শাসক দলের নেতাকর্মীরা জনতার জন্য সরকারি উন্নয়নের ‘সুফল’ পাওয়ার নিজস্ব শর্ত এবং প্রকরণ তৈরি করেছেন বলে অভিযোগ। প্রাপ্য সরকারি সুবিধের বেশিরভাগই নাকি পৌঁছচ্ছে শাসক দলের নেতা-কর্মীদের ‘হাত’ ঘুরে।

পাড়ায় পাড়ায় এই অসন্তোষের আঁচকেই অবিশ্বাসের হল্কায় পরিণত করার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন বিরোধীরা। ইলামবাজার, সিউড়ি, সাঁইথিয়া, লাভপুর, মহম্মদবাজার, সর্বত্রই কাটমানি বিতর্কে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের প্রায় একই ছবি।

বঞ্চনার অভিযোগের সঙ্গে বীরভূমে হাত ধরাধরি করে আছে গ্রাম দখলের রাজনীতি এবং সন্ত্রাস। এলাকা ভেদে যার মূল কারিগররা চিরকাল মোটামুটি এক বলেই অভিযোগ। পরিস্থিতির প্রয়োজনে কী ভাবে তাদের রাজনৈতিক ‘আশ্রয়’ শুধু বদলে গিয়েছে, সে কথাই বলছিলেন পাড়ুই বাসস্ট্যান্ডের এক চা বিক্রেতা। ২০১৪ সালে বোলপুরের ডাকবাংলো মাঠের জনসভা থেকে নিমাই দাস, সদাই শেখ, রেজাউল শেখের মতো প্রায় ৫০০ কর্মী বিজেপিতে যোগ দেন। পরের কয়েক বছরে জ্বলতে শুরু করে পাড়ুই। সেই ছবি বদলে যায় ওই নেতারা শাসক দলে ফিরে আসায়। ‘বিরোধী শূন্য’ পাড়ুই এখন তুলনামূলক ভাবে শান্ত। তবে বীরভূমের অন্য অংশে সংঘাতের আবহ বাড়ছে।

‘‘বীরভূমে হিংসার রাজনীতিতে আধিপত্য এবং সন্ত্রাস পরস্পরের পরিপূরক,’’ বলছিলেন এক বাম নেতা। তাঁর মতে, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর আধিপত্য ভাঙতে ‘সন্ত্রাস’ যেমন অস্ত্র, তেমন ক্ষমতার বিপরীতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতেও সন্ত্রাস হয়ে ওঠে ‘অনিবার্য’। সন্ত্রাসের কারিগরেরা তাই জেলার রাজনীতিতে বরাবরই ‘শক্তিপীঠ’। তাদের অনেকেই এখন বিজেপিমুখী বলে খবর। যা রাজনৈতিক হানাহানির বাড়বাড়ন্তের অন্যতম কারণ বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।

বীরভূমে বিজেপির নতুন জেলা সভাপতি শ্যামাপদ মণ্ডল অবশ্য বলেছেন, ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, এমন কাউকে দলে নেওয়ার আগে তাঁরা ভাববেন। জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কালোসোনা মণ্ডলের অবস্থানও তাই। তবে তিনি এ-ও বলেছেন, ‘‘তৃণমূল যে ভাষায় কথা বলবে, সেই ভাষাতেই উত্তর পাবে।’’ এরই মধ্যে জেলা জুড়ে কুলকুল করে বইছে ধর্মীয় মেরুকরণের হাওয়া। রাঢ়বঙ্গে প্রথাগত ধর্মঠাকুরের পোড়া মাটির ঘোড়ার থানের জায়গা নিচ্ছে বজরংবলির মন্দির। দ্রুত এগোনোর জমি খুঁজছে বিভাজনের হাওয়া।

সিউড়ির এক ব্লক তৃণমূল নেতা অবশ্য বলছিলেন, ‘‘সংক্রমণ আছে তবে জ্বর অল্প। দীর্ঘস্থায়ী হবে না। স্বাভাবিক নিরাময়ে ভরসা রাখছি।’’

আর চিকিৎসককে জিজ্ঞাসা করলে ‘থ্রি ইডিয়টসের’ র‌্যাঞ্চোর মতো উত্তর মিলছে, ‘‘সব ঠিক আছে।’’

অল ইজ ওয়েল?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Anubrata Mandal TMC Birbhum
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE