Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
West Bengal News

ঘোষণার সাত দিন আগেই লকডাউন সেনবাড়িতে! তাক লাগাচ্ছে দুই খুদেও

সব্জি বা মাছ কিনছেন দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। দড়িতে বেঁধে বালতি নামিয়ে দিচ্ছেন। মাছওয়ালা বা সব্জিওয়ালা তাতেই ঢেলে দিচ্ছেন সব।

মোদী বা মমতা লকডাউন ঘোষণা করার অনেক আগেই নিজেদের বাড়িতে লকডাউন জারি করে দিয়েছে এই পরিবার। —নিজস্ব চিত্র

মোদী বা মমতা লকডাউন ঘোষণা করার অনেক আগেই নিজেদের বাড়িতে লকডাউন জারি করে দিয়েছে এই পরিবার। —নিজস্ব চিত্র

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২০ ১৪:১৪
Share: Save:

দুপুর একেবারে খাঁ খাঁ করছে। একে চৈত্র সংক্রান্তির রোদ। তায়ে লকডাউনীয় শূন্যতা। লেক গার্ডেন্স সমবায় আবাসনের গলির মুখে ঝাঁকড়া-মাথাভারী একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে দুই পুলিশকর্মী চার দিকে নজর রেখেছেন। নজর না রাখলেও যে রাস্তায় নেমে পাড়ার লোকজন তুমুল হট্টগোল জুড়ে দিতেন, পরিস্থিতি দেখে তা মনে হয় না। তবে অবাক করে দিচ্ছে ওই ঝাঁকড়া গাছের ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা দোতলা বাড়িটা। করোনা-সতর্কতার নজিরে লেকগার্ডেন্সের ওই সেনবাড়ি এখন সম্ভবত গোটা দেশের কাছে আইকন হয়ে ওঠার পথে।

প্রধানমন্ত্রী মোদীর আহ্বানে ২২ মার্চ গোটা দেশে ‘জনতা কার্ফু’। তার পরের দিন অর্থাৎ ২৩ মার্চ মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা— রাজ্যের সব পুর এলাকা এবং জনবহুল এলাকায় লকডাউন জারি হবে। ২৪ মার্চ বিকেলে ফের মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা— শুধু পুর এলাকা নয়, রাজ্যের সর্বত্র লকডাউন, ৩১ মার্চ পর্যন্ত। আর সে দিন রাতেই প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা গোটা দেশে লকডাউন, ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। ১৪ এপ্রিলও যে লকডাউন উঠছে না, তা-ও স্পষ্ট। তবে, লেকগার্ডেন্সের সেনবাড়ি তা নিয়ে ভাবিত তো নয়ই, বরং শুনলে অবাক হতে হচ্ছে যে, মোদী বা মমতার অনেক আগেই নিজেদের বাড়িতে লকডাউন ঘোষণা করে দিয়েছিল ওই পরিবার।

১৭ মার্চ থেকে পরিচারিকাকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে দিন থেকেই আর কেউ বাড়ির বাইরে বেরচ্ছেন না। বাইরের কেউ সে বাড়িতে ঢুকছেনও না। সব্জি বা মাছ কিনছেন দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। দড়িতে বেঁধে বালতি নামিয়ে দিচ্ছেন। মাছওয়ালা বা সব্জিওয়ালা তাতেই ঢেলে দিচ্ছেন সব। বালতি তুলে নিয়ে জিনিসপত্র গরম জলে চুবিয়ে রাখা হচ্ছে কয়েক ঘণ্টা। তার পরে তাতে হাত দেওয়া।

কিন্তু ব্যালকনি থেকে শুধু মাছ আর সব্জি কিনে নিলেই কি হয়ে গেল? আর কোনও কিছুর প্রয়োজন পড়ছে না? খাঁ খাঁ দুপুরে নীচের তলায় নেমে এলেন বছর বাষট্টির শর্মিষ্ঠা সেনগুপ্ত। সদর দরজার একটা পাল্লা খুলে ভিতরে দাঁড়িয়েই বললেন, ‘‘আর প্রয়োজন পড়ে ওষুধের। সাধারণ জ্বর, সর্দি-কাশি বা পেটের ওষুধ তো বাড়িতে রাখতেই হয়। সে সব আগে থেকেই নিয়ে রেখেছিলাম। এ ছাড়া আমাকে কিছু ওষুধ খেতে হয়, কারণ কিছু দিন আগে আমার একটা অপারেশন হয়েছে। সে ওষুধও অনেকটাই কিনে নিয়েছি। জুন মাস পর্যন্ত চলবে।’’

চাল, ডাল, তেল, নুন, মশলা, ডিম ঘরে মজুত। সব্জি আর মাছ ব্যালকনি থেকে কিনে নিচ্ছেন। ওষুধ জোগাড় করে রেখেছেন। এর বাইরে আর কিছু প্রয়োজন বলে মনে হলেও সে সব মনে হওয়াকে আপাতত পাত্তা দিচ্ছে না সেনবাড়ি। লকডাউন না ওঠা পর্যন্ত বাইরে বেরনোর কোনও প্রশ্নই ওঠে না— বাড়ির প্রত্যেক বাসিন্দা একমত।

পড়াশোনার চাপ নেই। বাইরে বেরনোও নেই। অবসর কাটছে ঘরের কাজকর্ম করে। —নিজস্ব চিত্র

আরও পড়ুন: ৩ মে পর্যন্ত বাড়ল লকডাউন, নতুন ছাড়-কড়াকড়ি নিয়ে নির্দেশিকা কাল: প্রধানমন্ত্রী

কিন্তু মালপত্র বা ওষুধ যে আগে থেকে মজুত করা দরকার, সে কথা সেনবাড়ির বাসিন্দারা বুঝলেন কী ভাবে? ‘জনতা কার্ফু’র কথা ঘোষিত হওয়ার পর থেকে হয়তো অনেকে আঁচ করতে শুরু করেছিলেন যে, অন্যান্য দেশের মতো ভারতেও লকডাউন হতে পারে। কিন্তু সেনবাড়ি তো তারও অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে ১৭ মার্চ থেকে নিজেদেরকে লকডাউন করে ফেলেছে! শর্মিষ্ঠা বললেন, ‘‘আমার মেয়ে মুম্বইতে থাকে। ওখানে পরিস্থিতি আগে থেকেই খারাপ হচ্ছিল। ওদের অভিজ্ঞতা জানতে পারছিলাম। পরিস্থিতি যে এই দিকেই গড়াতে পারে, সে কথা ওরাও জানাচ্ছিল। ফলে আগে থেকে সতর্ক হতে পেরেছি।’’

শুধু আগে থেকে আঁচ করতে পারলেই অবশ্য হয় না। লকডাউন প্রোটোকল অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার মতো দায়িত্ববোধও থাকা চাই। লকডাউন ঘোষণার পরেও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকানপাট খোলাই থেকেছে। ফলে লকডাউনে বেরবেন না বলে যদি কেউ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতেন, তা হলে প্রথম কয়েক দিনে কেনাকাটা সেরে অনেকেই নিজেদের ঘরবন্দি করে ফেলতে পারতেন লেকগার্ডেন্সের সেনবাড়ির মতোই। কিন্তু অনেকেই তা করেননি। ভিড় এড়িয়ে চললেও বাজারে-দোকানে যাওয়া এখনও অনেকেই বন্ধ করেননি। তাঁদের কাছে কিন্তু ‘রোলমডেল’ হয়ে উঠতে পারেন দক্ষিণ কলকাতার এই বাড়িটার বাসিন্দারা।

আরও পড়ুন: ৩ মে পর্যন্ত লকডাউন, চলবে না মেট্রো, লোকাল-এক্সপ্রেস-মেল ট্রেন

সেনবাড়িতে যে শুধু প্রবীণরাই থাকেন, তা কিন্তু নয়। শর্মিষ্ঠা, তাঁর স্বামী পার্থসারথি সেনগুপ্ত এবং শর্মিষ্ঠার দিদি পদ্মা সেন পরিণত বয়সের। কিন্তু তাঁদের সঙ্গেই থাকে তাঁদের নাতনি অলিনী সেন এবং নাতি অনঘ সেন। অলিনী দ্বাদশ শ্রেণিতে, অনঘ সপ্তম শ্রেণির। লকডাউন প্রোটোকল মেনে চলার প্রশ্নে দাদু-ঠাকুমাদের টেক্কা দিচ্ছে সেই দুই স্কুল পড়ুয়া। স্কুল বন্ধ থাকলেও অনলাইন পড়াশোনা তাদের চলছে। কিন্তু পড়াশোনা সেরেই দাদু-ঠাকুমাদের সঙ্গে ঘরের কাজে হাত লাগাচ্ছে ভাই-বোন। এক জন ঘর ঝাঁট দিচ্ছে, আর এক জন মুছছে। এক জন দাদুকে সরিয়ে দিয়ে আটা মেখে দিচ্ছে নিজে। আর এক জন ঠাকুমার কাছ থেকে রেসিপি বুঝে নিয়ে রান্নাটা করে ফেলছে। কিন্তু বাড়ির বাইরে পা রাখার কথা ভুলেও বলছে না ভাই-বোনের কেউই।

ঘর থেকে বেরনো তো দূরের কথা, সারা দিন ঘরে থেকে দাদু-ঠাকুমার কাজ ভাগ করে নিচ্ছে এই পরিবারের ছোটরা। —নিজস্ব চিত্র

শর্মিষ্ঠা বললেন, ‘‘ওরা ছোট থেকেই স্বাবলম্বী হতে শিখেছে। ওদের বাবা-মা বাইরে থাকে। ওরা এখানে। এবং নিজেদের সব কাজ ওরা নিজেরাই করে। এখন যে সব কাজ ওরা করছে, সে সব আগে করতে হত না। কিন্তু ওদের অভ্যাসটা এমন ভাবেই তৈরি হয়েছে যে, বাড়ির সব কাজকেই ওরা বাকিদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চায়।’’

অলিনী এবং অনঘের বাবা ঝাড়খণ্ড হাইকোর্টের বিচারপতি। ফলে রাঁচীর বাসভবনে অনেক রকম সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন তাঁরা। মেয়ে বা ছেলে ছোট থেকে ওই জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ুক, বাবা-মা তা চাননি। তাই কলকাতায় ঠাকুমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন দু’জনকেই। লেকগার্ডেন্সের বাড়িতে সাধারণ জীবনেই বড় হচ্ছে তারা। নাতি-নাতনি যে যথেষ্ট স্বাবলম্বী, দাদু-ঠাকুমারা তা জানতেন। কিন্তু লকডাউনের দিনগুলোয় অলিনী-অনঘকে দেখে তাঁরা একটু চমকেই যাচ্ছেন। আপ্লুতও হচ্ছেন।

চমক কিন্তু আসলে গোটা পরিবারটাই দিচ্ছে। একনাগাড়ে সরকারি বিজ্ঞাপন আর পুলিশি তৎপরতা সত্ত্বেও লকডাউনের নিয়ম-কানুন না মানার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে অনেকের মধ্যেই। নোভেলকরোনার সংক্রমণ রুখতে হলে লকডাউনটা যে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা জরুরি, এখনও সম্ভবত এ দেশের অনেকেই তা বুঝে উঠতে পারছেন না। লেকগার্ডেন্সের সেনবাড়ি যেন সেই সব কিছুর মাঝে একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। গোটা দেশের সামনে যেন নজির হয়ে ওঠার মতো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

COVID-19 Lake Gardens South Kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE